Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৪৩
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৪৩

গোপা মিত্র

শীতল মরুর দেশে—লাদাখে

পর্ব ২

 

‘খারদুং লা’। আজ থেকে সেই কত কত বছর আগে প্রথমবার মানালি (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত –১) গিয়ে এক পাহাড়ের ধারে দেখেছিলাম, পথনির্দেশ ‘KhardungLa – Highest Motorable Mountain Road in the World’. খুব ইচ্ছে হয়েছিল একবার অন্ততঃ সেই রাস্তা ধরে ‘খারদুং লা’য় যাবার। কিন্তু সেদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি, ফিরে এসেছিলাম মানালি থেকেই। আজ অনেক দিন পর মনের কোণে ঘুমিয়ে থাকা, সেই সুপ্ত বাসনা পরিণতি পেতে চলছে – চলেছি খারদুংলার (১৮,৩৮০ ফুট) পথে। অবশ্য অতি সম্প্রতি আমি জেনেছি, এখন আর খারদুংলা সর্বোচ্চ মোটরপথ নয়। সেই জায়গা নিয়েছে উমলিংলা (১৯,৩০০ ফুট), যা লাদাখের দুটি গ্রাম চিশুমেল ও ডেমচককে যুক্ত করেছে। আমার কাছে অবশ্য এর জন্য খারদুংলার মাহাত্ম্য একটুও ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে হয় না। এভারেষ্ট আছে বলে কি কাঞ্চনজঙ্ঘার গৌরব অস্তমিত হয়েছে বলা যায়?

না, মাঝপথ থেকে নয় এবার তাহলে শুরু করি শুরু থেকেই। পরদিন, অর্থাৎ গুম্ফা ও সিন্ধু দর্শনের পরের দিন আমাদের যাবার কথা প্যাংগং সো। তৈরী হয়ে নিচে নেমে ডাইনিং হলে পৌঁছে শুনি আজ আমাদের প্যাংগং সো যাওয়া হচ্ছে না। অত্যধিক তুষারপাতে রাস্তা ঢেকে গেছে বরফে। দুদিনের মধ্যে সেই বরফ পরিস্কার না হলে প্যাংগং সো নয়, আমরা যাব সোমোরিরি। যাওয়া হবে না প্যাংগং সো? ভারত চীন সীমান্তের এই অপূর্ব হ্রদ দেখার বাসনা যে আমার বহুদিনের। কিন্তু কি আর করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চেষ্টার সঙ্গে ভাগ্যের সাহায্যেরও দরকার হয় – বিশেষ করে পাহাড়ে, যেখানে প্রকৃতি ভাগ্যদেবী যেমন রূপে আমাদের কাছে ধরা দেবে, তেমন রূপেই তাকে মেনে নিতে হবে। দেখা যাক ভাগ্য আমাদের কোন্‌ পথে নিয়ে যায়!

পর্যটন ম্যানেজার তখন বলছেন, আজ আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটরপথ খারদুংলা পার হয়ে যাব নুব্রা ভ্যালি। সেখানেই আজ আমাদের রাত্রিবাস। পরদিন ফিরব এই হোটেলে। সেজন্য সামান্য কিছু জামাকাপড় ও নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ছোট এক সাইডব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে মিনিট পনের কুড়ির মধ্যে নিচে নেমে আসতে হবে।

Heavy Breakfast সেরে আমরা যে যার গাড়ীতে উঠে বসলাম। মালপত্রের দায়িত্ব সংস্থার। আমাদের কাছে রইল শুধু আমাদের হাতব্যাগ। ম্যানেজারের কথামত আমরা সকলেই, সঙ্গে থাকা কোকা৬ খেয়ে নিয়েছি। প্রয়োজনে খারদুংলায় ওঠার আগে আরো একবার খাওয়া যাবে,আমাদের বলে দেওয়া হল। আমাদের সকলের হাত ব্যাগেই রয়েছে কর্পূরের শিশি। ম্যানেজার আমাদের সকলকেই বারে বারে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, খারদুংলায় কারো যদি শ্বাসকষ্ট হয় বা শারিরীক অস্বস্তি হয়, তবে কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে, সে যেন সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীতে ফিরে এসে কর্পূরের ঘ্রাণ নেয়।

লাদাখের সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল নুব্রা উপত্যকা লে শহর থেকে প্রায় ১২৫ কিমি দূরে। নুব্রা শব্দের অর্থ মরুদ্যান। সাইয়ক আর নুব্রা বা সিয়াচেন নদী মিলে তৈরী করেছে এক বিশাল উপত্যকা – লাদাখ আর কারাকোরাম পর্বতমালার মধ্যবর্তী অঞ্চলে, যার উচ্চতা ১০,০০০ ফুটের উপরে। নুব্রা যাবার পথেই পেরোতে হয় উচ্চতম মোটরপথ খারদুংলা।

শুরু হল আমাদের যাত্রা। লে থেকে খারদুংলা পাস ৩৯ কিলোমিটার। শহর ছাড়িয়ে গাড়ী ধরলো এক নতুন পথ। এ পথে শুধুই চড়াই। পাকদন্ডী পথ ধরে গাড়ী উপরে উঠতে লাগল। ড্রাইভার সামনের এক আকাশছোঁয়া রুক্ষ পাহাড় দেখিয়ে বলল যে এর চূড়াতেই রয়েছে খারদুংলা পাস – বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরপথ। পুরো পথটাই সেনাবাহিনীর দখলে। গোঁত্তা খেতে খেতে গাড়ী ক্রমশঃ উপরে উঠছে। চড়াই হলেও ২৫ কিলোমিটার পর, South Pullu পর্যন্ত রাস্তা ভালোই বলা চলে। এখানেই প্রথম চেকপোষ্টে আমাদের গাড়ী থামল। এর পরের ১৪ কিলোমিটারকে ঠিক পথ বলা যায় কি? প্রাণান্তকর চড়াই। ধ্বসপ্রবণ অঞ্চল, মাঝে মাঝেই গড়িয়ে পড়ছে পাথরের টুকরো। গাড়ীর মধ্যে আমরা সবাই নিশ্চুপ, কানে বাজে শুধু ইঞ্জিনের একটানা গোঁ গোঁ আওয়াজ। অপ্রশস্ত পাথুরেপথ, হেয়ারপিন বেন্ড পার হয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম যেখানে, সেখান থেকে অনেক নিচে সবুজের মাঝে উঁকি মারা লে শহরের বিক্ষিপ্ত কিছু ঘরবাড়ী। চোখের সামনে বিস্তৃত লাদাখ গিরিশ্রেণী। বাইরে চেয়ে দেখলাম পথ উঠে গেছে উপরে ঠিক যেন ‘Z’ অক্ষর অর্থাৎ এবার ZigZag পথে উপরে ওঠা। জানি, রাস্তা খারাপ হলেও BRO (Border Road Organisation) এই রাস্তা সচল রাখতে সর্বদাই সচেষ্ট, কারণ পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন যাবার একমাত্র সড়কপথ এটাই।হঠাৎই থমকে গেল গাড়ী। সামনেই  বোর্ড লাগানো ‘Khardung La – World Highest Motorable Road 18,380 ft. Border Road Organisation.’ এই উচ্চতাই লেখা ছিল।

শ্বাসরোধকারী, বিপজ্জনক অথচ রোমাঞ্চকর পথ পেরিয়ে আমরা অবশেষে এসে পৌঁছলাম খারদুংলা টপে। গাড়ী থামল, আমরাও নামলাম, এখানে কিছুক্ষণের বিরতি। চারিপাশে পত্‌পত্‌ করে উড়ছে প্রার্থনা পতাকার সারি।

রয়েছে খারদুং বাবার মন্দির – বন্ধ। পৃথিবীর উচ্চতম কাফেটেরিয়া – দরজা খোলা, কিন্তু বন্ধ। স্যুভেনির শপ – খোলা। আমরা প্রায় সকলেই সেখান থেকে আমাদের পছন্দমত কিছু স্মারক কিনলাম। এসবই চালাচ্ছে সেনা জওয়ানরা। কাছেই সেনা ছাউনি, ক’জন সেনা সবদিকেই লক্ষ্য রাখছে। এই পর্যন্ত আমার সঙ্গে কল্যাণও ছিল। কিন্তু এরপর কে কোথায় গেল আমি জানি না – আমি তখন মগ্ন হয়ে গেছি খারদুংলায়। 

এই ক’দিনে লাদাখের যে শুষ্ক ধূসর রূপ দেখেছি, এখানে তার চিহ্নমাত্র নেই। আমার চোখের সামনে মেঘ কুয়াশার ঘোমটায় মোড়া, শুভ্র বরফের চাদরে সর্বাঙ্গ আবৃত হিমল চূড়াগুলি যেন আকাশ স্পর্শ করতে চায়। তাদের পায়ের নিচে, কালোর ছিটে দেওয়া সাদা অঙ্গাবরণে সজ্জিত হিমশৈলগুলি, চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে তখন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে আর একটু এগোলেই তাদের নাগাল পেয়ে যাব। কিন্তু আমার পায়ের তলার বরফ আমাকে এগোতেই দিচ্ছে না। আমার ভয় করছে, কিন্তু আমি চোখ ফেরাতেও পারছি না, নড়তেও পারছি না। আমি তখন স্থানুর মত নিশ্চল, চলৎশক্তিহীন। কি ভয়ঙ্কর অথচ কি সুন্দর ! আজ এতদিনে, এই বয়সে, এখানে এসে, ভয়ঙ্কর সুন্দরের প্রকৃত অর্থ আমি হৃদয়ঙ্গম করলাম। এর আগেও তো আমি অনেক পাহাড়ে গিয়েছি, বরফের উপর দিয়ে হেঁটেছি, কখনো অরুনাচল প্রদেশের সেলা টপ (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৯), কখনো মানালির রোটাং পাস (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১), কখনো কাশ্মীরের গুলমার্গ (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৬), আবার কখনো সিকিমের লাচুং ইয়ুমথাং (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৯)। কোথাও তো এমন মনে হয়নি। সে সব যেন শান্ত সমাহিত ঘুমন্ত বরফ। কিন্তু এখানে যা দেখছি, এ যেন ভয়ঙ্কর ভয় ধরানো – যে কোনো মুহূর্তে জেগে উঠে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। এর সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় গোমুখের সেই বরফ দৃশ্য। এবার বুঝতে পারলাম ভাগ্যদেবী সত্যিই আমার প্রতি প্রসন্ন – গতকালের অত্যধিক তুষারপাতের জন্যই কি খারদুংলা আমার কাছে এমন অপরূপ রূপে ধরা দিল? শুনেছিলাম, খারদুংলা টপ বিখ্যাত সব পর্বতমালা দেখার ভিউ পয়েন্ট। কিন্তু মেঘ কুয়াশার আবরণ আর বরফ ধাঁধাঁনো শিখরমালা ভেদ করে সেই কারাকোরাম, জাঁসকার, হিমালয় খুঁজতে গেলে আমার এখন X-Ray Eye দরকার।

কতক্ষণ সেখানে ছিলাম জানি না। ইতিমধ্যে আকাশের মেঘ নেমে এসেছে নিচে। সেই কালিমায় চারিপাশ প্রায় অদৃশ্য। মেঘের আচ্ছাদন ছিঁড়েখুঁড়ে শুধুমাত্র জেগে রয়েছে আশেপাশের কয়েকটি শুভ্র শিখর। হঠাৎই পাশ থেকে কে যেন বলল “ম্যাডাম এবার ফিরে যান। যে কোনো মুহূর্তে আবহাওয়া খারাপ হলে, বিপদে পড়বেন”। বুঝলাম অতন্দ্র প্রহরী সেনা জওয়ানরা সব সময়ই সতর্ক থেকে পর্যটকদের ওপর নজর রাখে। হাড় কাঁপানো ঝোড়ো ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ফিরে এলাম গাড়ীতে।

সেখানে তখন সকলেই কর্পূরের শিশি থেকে ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত। কল্যাণও রয়েছে তাদের মধ্যে। এতক্ষণ আমার কোনো অস্বস্তি বোধ হয়নি বা বোধ হলেও বাইরের জগতের মগ্নতা আমাকে বুঝতে দেয়নি। ফিরে এসে আমাকেও কর্পূরের ঘ্রাণ নিতে হল।

সর্বোচ্চ পথে হাঁটাহাঁটির অভিজ্ঞতা নিয়ে, আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা – তবে এবার উৎরাই পথে। এদিকেও North Pulluপর্যন্ত রাস্তা খারাপ, তারপর ঠিক আছে। কিছুটা পথ নেমে, পড়লো ছোট্ট গ্রাম খারদুং। পথের ধারে এক গর্ত থেকে উঁকি মারলো অদ্ভূত দর্শন এক প্রাণী – মারমট। খরগোস আর ইঁদুরের মিশ্র প্রজাতি, এদের গঠন অনেকটা ভোঁদড়ের মত। আমাদের দেখেই সে আবার ঢুকে গেলো গর্তে।

গড়গড়িয়ে কিছুটা নেমে এসে আমরা পৌঁছে গেলাম সাইয়ক নদী তীরে। সিয়াচেন হিমবাহ থেকে নুব্রা নদী জন্ম নিয়ে নুব্রা উপত্যকার উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে সাইয়ক নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে শেষপর্যন্ত দুই নদীই সিন্ধু নদে বিলীন হয়ে গেছে।

আবার সেই রুক্ষ ধূসর পাহাড়ের সারি। তার সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে সাইয়ক নদী। নদীতীর ধরে পৌঁছে গেলাম খালসার। সামনেই ফুটে উঠল নুব্রা উপত্যকার অনবদ্য সৌন্দর্য। দূরে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কারাকোরাম পর্বতমালা। ধূসর রুক্ষ পর্বতশিখরে বরফের আলপনা।

কিন্তু আমরা এখানে না থেমে এগিয়ে চললাম এই পথের শেষ ঠিকানা হুন্ডারের দিকে। হুন্ডারের বিস্তৃত শীতল মরুপ্রান্তরের বালুর রঙ রূপোলী সাদা – জয়শলমীরের (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১২) সোনালী হলুদ বালুভূমি থাকে একেবারেই অন্যরকম। লাদাখের সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল নুব্রা  উপত্যকা। নানা আকৃতির বালিয়াড়ি, তাদের কোলে ছোট ছোট জলাশয়, মাঝে মাঝে কাঁটাগাছের জঙ্গল,অচেনা কোনো ঝোরার ঝিরিঝিরি জলধারা, বয়ে চলা সাইয়ক নদী আর দূরে উত্তুঙ্গ জমকালো কারাকোরাম পর্বতের বিস্তার – সবই ধরা দেবে এখানে, এক ফ্রেমে। মাঝেমাঝেই ঝোড়ো হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে সেই বালিয়াড়ির রূপ। গাড়ী থেকে নেমে, সেই বালিয়াড়ির ঢেউ ভেঙে আমরা এগিয়ে চললাম যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে রয়েছে বিরল প্রজাতির দুই কুঁজ বিশিষ্ট উটগুলি – এই মরুভূমির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, ‘ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল’। মধ্য এশিয়া থেকে রেশম পথ ধরে এই উট এসেছে নুব্রা উপত্যকায়। তারপর বংশ বিস্তার করে রয়ে গেছে এখানেই। এদের পিঠে রয়েছে একটির বদলে দুটি কুঁজ – এটাই এদের বিশেষত্ব। শীতল মরুর বুকে বালির সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে ক্যামেল সফারী, আমার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জয়শলমীরের ক্যামেল সফারী (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১২) আর এখানের ক্যামেল সফারী দুই যেন দু’রকম।

কিছুক্ষণ উটের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়িয়ে, পিঠ থেকে নেমে হেঁটে বেড়ালাম বালির উপর দিয়ে। তারপর উপত্যকার উপর দিয়ে বয়ে চলা ঝোরার উপরের অস্থায়ী কাঠের সাঁকো পেরিয়ে হেঁটে চললাম সাইয়ক নদী তীরে। মাথার উপরে অনন্ত অসীম নীলাকাশ, পায়ের নিচে রুক্ষ শুষ্ক মরুবালু, সামনে দিয়ে উপল বন্ধুর পথে ছোট ছোট ঢেউ তুলে বয়ে চলা সাইয়ক নদী আর দূরে বিস্তৃত কারাকোরামের পটভূমি, এমন উন্মুক্ত প্রকৃতির উপুড় করা সৌন্দর্যে সাজানো, এত সুবিশাল এক ডাইনিং হলের নিরিবিলি নির্জনে আমরা, মাত্র আমরা কয়েকজন, সংস্থার আনা আহার্য দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সম্পন্ন করলাম। মাত্র কয়েক পলের জন্য থমকে থাকা সময় আবার সচল হল – শুরু হল আমাদের এগিয়ে চলা সুমুরের উদ্দেশ্যে। আজ সেখানেই আমাদের রাত্রিবাস, সঙ্গে নিয়ে চললাম অবিস্মরণীয় এই কয়েক পলের স্মৃতি। 

আমরা আবার সাইয়ক নদী তীর ধরে ফিরে চললাম খালসার। এখান থেকে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ গেছে গঞ্জ শহর দেস্কিটের দিকে, আর অন্য ভাগ নুব্রা নদীর ধারে সুমুর গ্রামের দিকে। এই উপত্যকার সবুজ গ্রাম সুমুরের দূরত্ব খালসার থেকে২০ কিমি।বাঁধানো রাস্তা  ধরে সমভূমির উপর দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ী। যে পথ দিয়ে আমরা এখন চলেছি, প্রাচীনকালে এই পথই ছিল রেশম পথ বা সিল্ক রুট। যাযাবর সওদাগরেরা তাদের সওদা সামগ্রী নিয়ে এই পথেই পাড়ি দিত দূর দেশে। গ্রামের গা দিয়ে বইছে খরস্রোতা নুব্রা নদী। পথের দু’পাশে গাছপালার সারি,‌‌ চাষের ক্ষেত বা চেনা অচেনা রঙীন মরসুমী ফুল।

পথিপার্শ্বের ছোট্ট এক দোতলা হোটেলে আমাদের কজনের থাকার ব্যবস্থা হল। বাকীরা গেল আর একটু দূরে গাছপালার মধ্যে দিয়ে অন্য এক হোটেলে।

রেশম পথে কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটে ইতিউতি ঘুরে বেড়ালাম। অবশ্য যাবার জায়গা আর কোথায় ? একটাই তো মাত্র বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে সোজা। পথের মাঝেই এক বিশাল তোরণ, তার উপরে লেখা, ‘WELCOME FROM TIGER THUNDEL TSOGSPA’ দেখা হলো কয়েকজন সেনা জওয়ানের সঙ্গে। আর একটু এগোলে পানামিক গ্রাম। ব্যস্‌ তারপরেই সাধারণের জন্য পথ রুদ্ধ। এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে মাত্র কয়েক ঘন্টার সফরে পৌঁছে যাওয়া যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন – যেখানে মাইনাস তাপমাত্রায় জমে থাকা বরফের মধ্যে প্রচন্ড ঠান্ডায় চব্বিশ ঘন্টা অতন্দ্র প্রহরারত ভারতীয় সেনাবাহিনী, ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

পরদিন সকালে জলযোগের পর নুব্রা ভ্যালিকে বিদায় জানিয়ে সাইয়ক নদীকে সঙ্গী করে সেই একই পথ ধরে ফিরে চললাম লে’র দিকে। পথে দেখলাম বুনো গাধা কিয়াং। এবারেও দেখা হল খারদুংলার সংগে, তবে এবার আর নামা হল না।বিকেলের আগেই পৌঁছে গেলাম আমাদের অস্থায়ী বাসস্থান লে’র সেই হোটেলে। এখন আর কোথাও বেরোন নয়। রাস্তা পরিষ্কার, কাল যাব প্যাংগং সো।

— দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত —

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. মন্তব্য পেয়ে খুব ভালো লাগলো।

  2. দারুণ সব বর্ণনা।তোমাকে আর কল‍্যাণদা কে আমার salute for your adventurous spirit.ছবিগুলো খুব সুন্দর উঠেছে।

Leave a Reply to Srijit Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!