Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৪১
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৪১

গোপা মিত্র

কাজিরাঙার অন্দরে

অসম ট্যুরিজমের ‘বনশ্রী’ বনবাংলোটি একেবারেই বনাঞ্চলের সীমানায় –তিনদিক থেকে তার ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া গভীর অরণ্য মিশে গেছে অতল খাদে, উপর থেকে তার ঝরে পড়া এক ঝরণার ঝর্‌ঝর্‌ জলরাশি অরণ্যখাদের কোন্‌ গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে এত উঁচু থেকে তা বোঝা একেবারেই অসম্ভব। এগিয়ে যাওয়ার বা নিচে নামার কোনো উপায়ই নেই, কারণ পথ এই বাংলোতেই শেষ। বাংলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সুউচ্চ মোটা তারের জাল দিয়ে বাংলো এবং সংলগ্ন মরশুমী পুষ্পশোভিত উদ্যানটি একেবারে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। আমরা রয়েছি তারজালের এপারে আর অরণ্য তারজালিকার ওপারে।

২০১০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি অরুণাচল (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত-পর্ব ৯ ও ১০) বেড়িয়ে ফেরার পথে অসম অরুণাচল সীমান্তে ভালুকপং হয়ে আমি আর কল্যাণ এসে পৌঁছেছি কাজিরাঙার দরজায়, একশৃঙ্গ গন্ডার আর হাতী দেখার আশায়। কলকাতা থেকেই অবশ্য ‘বনশ্রী’ বনবাংলোর বুকিং করে এসেছিলাম। গুয়াহাটি থেকে কাজিরাঙার দূরত্ব ২১৭ কিমি আর ভালুকপং থেকে প্রায় ১১০ কিমি – সড়ক পথে আমাদের সময় লাগল প্রায় আড়াই ঘন্টা।

অসমের একাধিক অভয়ারণ্যের মধ্যে কাজিরাঙা বৃহত্তম। এই অভয়ারণ্যের বিস্তার অসমের গোলাঘাট, কার্বি আংলং এবং নওগা জেলা জুড়ে। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ সংলগ্ন এই অরণ্য প্রায় প্রতি বছরই ব্রহ্মপুত্রের প্লাবনে ভেসে যায়। তখন এখানের বেশীরভাগ বন্য প্রাণী জাতীয় সড়ক অতিক্রম করে দক্ষিণে মিকির পাহাড় সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে চলে যায়। তাই কাজিরাঙা বন্ধ থাকে ১লা মে থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত।

বিশাল এই অরণ্য পর্যটকদের জন্য চারটি অঞ্চলে (Range) বিভক্ত। মধ্য ভাগের প্রবেশদ্বার কোহরা, পশ্চিম ভাগের বাগোরি, পূর্ব ভাগের আগারতোলি ও দক্ষিণ ভাগের বুরাপাহাড়। তবে জীপ রাইডে চারিদিক থেকে প্রবেশ করা গেলেও হাতী সফারী শুধুমাত্র কোহরা ও বাগোরির দিক থেকেই হয়ে থাকে। কোহরা থেকেই কাজিরাঙার Administration পরিচালিত হয়। ১৯০৪ সালের শুরুতে এই অরণ্যের বিস্তার ছিল মাত্র ৪৩০ বর্গ কিমি, এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০০০ বর্গ কিমিতে। ১৯৭৪ সালে এই উদ্যান পায় জাতীয় উদ্যানের শিরোপা আর ১৯৮৫ সালে এই অভয়ারণ্য পায় বিশ্ব ঐতিহ্যের জাতীয় উদ্যানের তকমা।

কাজিরাঙা পৃথিবী খ্যাত ভারতীয় একশৃঙ্গ বিশিষ্ট গন্ডারের Largest Population এর জন্য। এছাড়াও কাজিরাঙা বিখ্যাত বুনো হাতী, বুনো মোষ, জলা হরিণ (Swamp Deer) ও বাঘের জন্য।

আমরা এসে পৌঁছেছি প্রায় দুপুরের দিকে। আসার পথে জীপে বসেই নিচের ফাঁকা জমিতে দর্শন পেয়েছি চরে বেড়ানো একাধিক হাতীর। মাঝেমাঝেই থেমেছি আবার এগিয়েছি। এভাবেই এসে গেলাম কাজিরাঙার প্রবেশদ্বারে, যেখানে রয়েছে বাচ্চাসহ এক মা গন্ডারের মূর্তি।

আমাদের বনবাংলো কোহরা অঞ্চলে। মাত্র পাঁচ/ছটি ঘরের একতলা এই বাংলোটি একেবারেই নির্জনে বনবাসের উপযুক্ত। তবে খাবার ব্যবস্থা এখানে নেই। তার জন্য যেতে হয় সংলগ্ন উদ্যান ছাড়িয়ে বাঁধানো পথ ধরে খানিকটা পিছিয়ে ট্যুরিজমের আরো একটি লজ ‘বলাকা’য়। দোতলা এই লজটি একেবারে শহুরে সভ্যতার উপযুক্ত। সামনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে গাড়ী রাখার ব্যবস্থা। নিচে বসার ও খাবার ঘর, রয়েছে এক টিভিও। দোতলার বারান্দা থেকেই দেখা যায় নিচের ড্রাইভওয়ে।

কাজিরাঙার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্রই নয়, তার একাধিক উপনদী। তাছাড়াও রয়েছে একাধিক ছোট বড় বিল বা জলাশয়। তাই শীতকালই কাজিরাঙা ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারণ তখনই পরিযায়ী পাখীরা এসে ভীড় জমায় কাজিরাঙার নদী বিল বা জলাশয়ের ধারে আর দেখা মেলে হর্ণবিল, পেলিক্যান বা ইগ্রেটদের।

কাজিরাঙায় পৌঁছে বাংলোর কর্মচারীদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে প্রথম সুযোগেই আমরা চললাম এলিফ্যান্ট বুকিং সেন্টারে, পরদিনের হাতীর পিঠে চেপে জঙ্গল সফারীর জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে। কোনো অভয়ারণ্যে হাতী সফারী থাকলে আমি সব সময়ে, সেটাই বেশী পছন্দ করি। কারণ এই যে গাছপালা বা ‘হাতীঘাস’-এর মধ্যে দিয়ে হাতীর এগিয়ে চলা, তাতে আমার মনে হয় জঙ্গলকে যেন আমি অনুভব করতে পারছি, তার সঙ্গে যেন আমি একাত্ম হয়ে গেছি। তাছাড়া হাতীই খুঁজে নিয়ে আমাদের একেবারে বনচরদের সামনে উপস্থিত করে। নির্দিষ্ট পথ ধরে কম সময়ে জীপ সফারীতে বনের বেশী অংশ Cover করা যায় ঠিকই, তবে সেক্ষেত্রে অরণ্যচারীরা সামনে না এলে তাদের দেখা যায় না। তাছাড়া গাছপালার স্পর্শ ছাড়া বন ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় কি?

শীতের বিকেলে, ঘনায়মান অন্ধকারে, দুপাশের ঝুপসী গাছপালার মধ্যের সরু পথ ধরে আমরা সাবধানে এগিয়ে চলেছি তাদের বলে দেওয়া পথ ধরে। পথ ভুল হবার অবশ্য কোন সম্ভাবনাই নেই, কারণ পথ শুধুমাত্র একটাই। জনমানবশূন্য নির্জন রাস্তায়, পথিপার্শ্বের টিমটিমে ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় নিজেদের ছায়ার সঙ্গেই বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর, দেখলাম দূরের এক ঘরে আলো জ্বলছে , আর টেবিল চেয়ার পেতে বসে রয়েছে কয়েকজন কর্মচারী। সেখানে টাকা জমা দিয়ে, পরদিন ভোরের প্রথম হাতী সফারীর জন্য নাম নথি্ভুক্ত করার পরে তাদের কাছ থেকেই জেনে নিয়ে স্থানীয় একজন জিপ্‌সী চালকের সঙ্গেও কথা বলে নিলাম। সে পরদিন ভোরে এসে আমাদের যেমন নিয়ে যাবে এলিফ্যান্ট রাইডিং পয়েন্টে, তেমনই আবার হয়ে গেলে ফিরিয়ে আনবে এই বনবাংলোয়।

পরদিন সকালে চা বিস্কুট খেয়ে আমরা জিপসীতে চলেছি এখান থেকে ৪ কিমি দূরের কোহরা অঞ্চলের বনের প্রবেশ দ্বার মিহিমুখে। সেখানে পৌঁছে গাড়ী থেকে নেমে তাদের বুকিং স্লিপ দেখাতে তারা গেট খুলে দিল। একটু এগোতেই দেখলাম ছোট এক বাঁধানো সিঁড়ির পাশে হাতীর দল, আর সেখানে ভীড় জমিয়েছে প্রচুর পর্যটক, মাহুত, কজন কর্মচারী ও বন্দুকধারী বেশ কিছু বনরক্ষী। পর্যটকদের বেশীর ভাগই অবশ্য বিদেশী।

কর্মচারীরা স্লিপ দেখে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হাতীটি দেখিয়ে দিল। আমরা সেই ছোটো সিঁড়ি দিয়ে উঠে হাতীর পিঠে চেপে বসলাম। চারজনের বসার ব্যবস্থা। আমরা পিঠে পিঠ দিয়ে চারজনে বসে পড়লাম, সামনে বসল মাহুত। ওরা আমাদের সঙ্গে একজন বন্দুকধারী বনরক্ষীও দিয়ে দিল। সে আমাদের হাতীর পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে আমাদের সঙ্গে যাবে – হয়ত বনে কোনো বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য সেই বিপদ আমাদের নাকি গন্ডারের ,জানিনা! দেখলাম প্রত্যেক হাতীর সঙ্গেই চলল একজন করে বনরক্ষী।

ভোর বেলা হাতীর পিঠে বসে কাজিরাঙার জঙ্গল ভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। অনেক বছর আগে এমনই বেড়িয়েছিলাম কানহা বান্ধবগড়ের (আমার ভমণ বৃত্তান্ত –পর্ব ১৫,১৬) জঙ্গলে- ফিরে এল সেই স্মৃতি। শিশু, হিজল, জারুল, শিমূল , এমন চওড়া পাতার নানারকম গাছগাছালির মাঝে মাঝেই রয়েছে ফাঁকা জমি বা কাদা জলা। বনের মধ্যে নাম না জানা নদী বা বিলও চোখে পড়ল।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অসাধারণ এই বনভূমির মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি ঝরাপাতায় মচ্‌মচ্‌ শব্দ তুলে। মাঝেমাঝেই কানে আসে নাম না জানা কোনো পাখীর ডাক – তাদের দেখা যায় না শুধু শোনা যায়। দূরে দেখা যায় পক্ষীকূলের দ্বারা সীমারেখা টানা কোনো নদীর ধার। আমরা এগিয়ে চলি কখনো একেবারে গাছপালার গা ঘেঁষে, কখনো জলা জমির পাশ দিয়ে, কখনো খাস জমি বা কখনো প্রায় মাথা ছাড়ানো হাতী ঘাসের মধ্যে দিয়ে। বাঘের দেখা পাওয়া অবশ্য ভাগ্যের ব্যাপার ঠিকই, তবে একশৃঙ্গ গন্ডার? সে তো হামেশাই পড়শী বন্ধুর মত আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে কোনো কাদামাখা গন্ডার, কখনো খড়্গ উঁচিয়ে পথরোধ করে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে নির্বিকার, নির্ভয়। মনে হচ্ছে ওরা জেনে গেছে ওদের দেখতেই আমাদের এখানে আসা।

হঠাৎই চোখে পড়ে অবোধ এক শিশু সহ মা বেরিয়েছে বনভ্রমণে। শিশুর খড়্গ তখনও পরিণত হয় নি। তাই হয়ত সে জড়িয়ে রয়েছে মায়ের সঙ্গে – কি যে স্বর্গীয় দৃশ্য ! মনে হল আমাদের কাজিরাঙা ভ্রমণ সার্থক। কেন যে আমাদের মত কিছু লোভী স্বার্থপরমানুষ নিজেদের স্বার্থে, মাকে মেরে তার খড়্গ কেটে নিয়ে এমন সব শিশুকে মাতৃহারা করে দেয়, কে জানে!

হাতী এগিয়ে চলে তার নিজস্ব ছন্দে, বলা যায় গদাইলস্করি চালে। আমরা তার পিঠে বসে নিজেদের ব্যালান্স করি, এদিক ওদিক মাথা সরিয়ে গাছপালার ঠোক্কর থেকে নিজেদের মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করি। কিন্তু উঁচু উঁচু হাতী ঘাসের ঝাপটা থেকে নিজেদের বাঁচাবার কোনো উপায় আমাদের জানা নেই। দু এক জায়গায় আবার হাতী দাঁড়িয়ে গেল – চেয়ে দেখি সে তখন পাশের গাছ উপড়ে পাতা খেতে ব্যস্ত। মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে কোনো হরিণের দল বা ইতিউতি চরে বেড়ানো দলছুট কোনো হরিণ। তবে হরিণ দেখার জন্য আমরা একেবারেই ব্যস্ত নই। কারণ বিভিন্ন প্রজাতির রং বাহারী বা শিং বাহারী অসংখ্য হরিণ তো আমরা আগেই দেখেছি কানহা বা বান্ধবগড়ে (আমার ভমণ বৃত্তান্ত-পর্ব ১৫ ও ১৬)।

কাজিরাঙার বিখ্যাত একশৃঙ্গ গন্ডার তো দেখা হল, কিন্তু বুনো মোষ বা জলা হরিণ তো এখনও চোখে পড়ল না!ভাবতে ভাবতেই গাছপালার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল একপাল বুনো মোষ – চেহারায় ভয়ঙ্কর হলেও চোখে তাদের অবোধ, সরল দৃষ্টি। একটু পরেই আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে তারা অন্যদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

আবার আমাদের এগিয়ে চলা। এবার খুঁজে পেলাম কাজিরাঙার আর এক বিখ্যাত বনচর, জলা হরিণ  (Swamp Deer)। মাহুত আমাদের চিনিয়ে দিল। সংখ্যায় অবশ্য বেশী নয়। দেখলাম, হরিণের মত রং বা শিং এর বাহার এদের নেই। এদের মধ্যে থেকে কালচে বাদামী বর্ণের মাত্র একটি হরিণ আমাদের সামনে এসে পোজ্‌ দিয়ে দাঁড়ালে আমরা তার ছবি তুলে নিলাম।

এখনও বুনো হাতীর দেখা নেই। সেই দেখেছিলাম গাড়ী করে আসার পথে, অনেক নিচে, কিন্তু একেবারে সামনে নয়। তবে কি ওদের না দেখেই ফিরে যেতে হবে? তখনই স্থির করলাম, বিকেলে আরো একবার আসব, হাতীর সন্ধানে, তবে এবার মধ্যভাগ কোহরার দিক দিয়ে নয়, প্রবেশ করব পশ্চিম ভাগ বাগোরির দিক দিয়ে।

বিকেলের হাতী সফারীর বুকিংএর পরে, গাড়ির ব্যবস্থা করে ফিরে এলাম বনবাংলোয়। প্রাতঃরাশ সেরে আপাততঃ বিশ্রাম। তারপর দুপুরের আহারের পর প্রতীক্ষা বনপ্রবেশের।

সাড়ে তিনটের মধ্যেই জীপ এসে হাজির আমাদের দরজায়। বাগোরি এখান থেকে প্রায় ১০ কিমি, – আমাদের বেরোতে হবে এখনই।

এগিয়ে চলেছে জীপ। দুপাশের চা বাগানের বুক চিরে পথ গিয়েছে জঙ্গলের দিকে। মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত শুধু চায়ের বাগান। ছোট ছোট ঝোপাকৃতি কালচে সবুজ চা বাগানগুলির মাঝে মাঝে খুঁটি পুঁতে নামকরা কোনো চা কোম্পানীর নাম লেখা। বিখ্যাত অসম চায়ের বেশীটাই আমাদের ঘরে পৌঁছয় এই সব চা গাছ গুলির পাতা থেকে।

পৌঁছে গেলাম বাগোরির প্রবেশদ্বারে। পাশেই ট্যুরিজমের অফিস। গাড়ী থেকে নেমে স্লিপ দেখিয়ে পৌঁছে গেলাম Elephant Ride Pointএ। দেখলাম, সকালের মত এখানে অত ভীড় নেই, হাতীর সংখ্যাও অনেক কম।

আবারও এক ছোট সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওরা এক হাতী দেখিয়ে উঠে বসতে বলল। এবারে দুজনের জন্য বসার হাতী–দুপাশে পা ছড়িয়ে সামনে চেয়ে বসা। মনে খুব আনন্দ,এবারে চারিপাশে অবাধে দৃষ্টিচালনা করতে পারব।বসতে গিয়েই বিপত্তি – দু পা দুদিকে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী বিস্তারে ছড়াতে গিয়ে মনে হল দুদিক থেকে পা দুখানা খুলে গিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। এছাড়া গদী থাকলেও হাতীর উঁচুনিচু শিরদাঁড়ার ওপর বসা- সেও এক কঠিন কাজ। না, হেরে গেলে চলবে না। মুখটি বুজে চুপটি করে সেই হাতীর পিঠেই চেপে বসলাম – পরে যা হয় হবে, দেখা যাবে!

সকালের মতই গাছপালা ভেদ করে হাতী ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে হাতী। এক বুনো শুয়োর পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল। কিন্তু বুনো হাতী? সে কোথায়? তার দেখা কি পাব না? ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে। এখন আর বনভূমি নিঃশব্দ নয়। অরণ্য মুখরিত চারিদিক থেকে ভেসে আসা কুলায় ফেরা অজস্র পাখীদের কলকাকলিতে। আর মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরই ফিরে যেতে হবে। তখনই চোখে পড়ল তাদের – ছোট বড়, বাচ্চা বুড়ো মিলিয়ে একপাল হাতী গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট এক কাদাজলার সামনে নিজেদের মধ্যে, সম্ভবতঃ কিছু একটা আলোচনায় ব্যস্ত। আমাদের তারা দেখতে পেল না, নাকি দেখেও অবজ্ঞা করল, জানি না! তাদের ছবি তুলে তাড়াতাড়ি ফিরে চললাম – কি জানি হঠাৎ যদি কোনো কারণে তারা বিরক্ত হয়ে ওঠে, তখন?

অরণ্য তখন প্রায় অন্ধকারে ঢেকে গেছে, আমরাও চলে এসেছি প্রবেশদ্বারের কাছে। তখনই নজর গেল পাশের ঘন সন্নিবদ্ধ গাছের ফাঁক দিয়ে দুজোড়া জ্বলন্ত চোখ আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। হয়ত তারা ভাবছে এমন অন্ধকারে তাদের রাজত্বে এরা আবার এখানে কি করছে! সন্ধ্যার অন্ধকারে একই পথ ধরে ফিরে এলাম লজে।

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের পর বার হলাম আশপাশ দেখতে। একটা মাত্রই পথ। সেই পথ ধরে দুপাশের অরণ্য সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললাম। দূরে দূরে বনমধ্যে নজরে এল দু’একটি বাসস্থান, সবই শুনলাম পর্যটক আবাস। মাত্র যে দু একজন পথচারীর সঙ্গে দেখা হল, তারা সবাই লজ বা বনকর্মী। যেহেতু আমরা রয়েছি একেবারে বনমধ্যে – তাই এখানে সাধারণের বসতি নিষিদ্ধ।

বিকেলে লজ সংলগ্ন উদ্যানে বেড়াচ্ছি, এমন সময় চারিদিক আচ্ছন্ন করে নেমে এল আশ্চর্য এক অন্ধকার। আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখলাম, তারাহীন আকাশ কালীবর্ণ মেঘের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য। শুরু হল প্রথমে টিপ্‌টিপ্‌, পরে ঝম্‌ঝম্‌ বৃষ্টি, সঙ্গে মেঘের গর্জন – কখনো দ্রিমি দ্রিমি কখনো হুহুঙ্কারে। গগনবিদারী বিদ্যুতের তরবারির ঝল্‌সানি মেঘের অন্ধকার একবার চম্‌কে দিয়েই আবার আঁধারে ঢেকে দিচ্ছে। শোঁশোঁ শন্‌শন্‌ বায়ু গর্জন যেন এসবের সঙ্গেই তাল দিচ্ছে। সেই তালে নেচে চলেছে বনের গাছপালা- কখনো একেবারে নতজানু হয়ে প্রকৃতি দেবীকে প্রণাম জানাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই মাথা তুলে নতুন কোনো মুদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আমরা এসে বসেছি বনবাংলোর বারান্দায়। বন্ধ ঘরের নিরাপত্তায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। জঙ্গলে এমন বর্ষণমন্দ্রিত রাতের অন্ধকার কি আর কোনো দিন ফিরে পাবো?চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকতে (আমার ভমণ বৃত্তান্ত-পর্ব২৩)বা নৈনিতালের পাহাড়ে (আমার ভমণ বৃত্তান্ত-পর্ব১৪) সাক্ষী থেকেছিলাম এমনই এক বর্ষণ মুখরিত রাতের। দেখেছিলাম প্রকৃতির এক অন্যরকম নৃত্য – মৃদুলয় থেকে দ্রুতলয়, আবার ফেরা মৃদুলয়ে, তারপর সমাপ্তি। কিন্তু প্রকৃতির এমন একটানা তান্ডব নৃত্য, আগে তো কখনো প্রত্যক্ষ করিনি!

আবশেষে বৃষ্টি কমল ঠিকই, কিন্তু একেবারে থামল না ,আর মেঘের আবরণও সরলো না। আমরা আর অপেক্ষা না করে এগিয়ে চললাম ‘বলাকা’-র দিকে রাতের আহারের জন্য। আটটা তখনো বাজে নি। কিন্তু আমরা কোনো ঝুঁকি নিলাম না। ঘর থেকে বেরিয়ে ভেজা বাগান মাড়িয়ে টিপ্‌টিপ্‌ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দুপাশের গাছপালার ঝুপ্‌সি অন্ধকারের জঙ্গল, বাঁশঝাড় থেকে ঝরে পড়া টুপ্‌টাপ্‌ জলের শব্দ, ঝিঁঝিঁর ঐকতান, ব্যাঙের ডাকের মধ্যে দিয়ে ল্যাম্পপোষ্টের আব্‌ছা আলোয়, আমরা, মাত্র আমরা দুজন, এগিয়ে চললাম নিরিবিলি নির্জন বাধাঁনো পথ ধরে ‘বলাকা’র দিকে। জল অবশ্য কোথাও দাঁড়ায় নি। ঢাল বেয়ে নেমে গেছে কোন্‌ অতল খাদের গভীরে, তা দেখার চেষ্টাই বৃথা।

আগামীকাল সকালেই আমাদের ফিরে যাওয়া গৌহাটিতে। সেখানে অসম ট্যুরিজমের ‘প্রশান্তি’ লজে আমাদের দুদিনের বুকিং করা আছে। গাড়ীর কথা জিজ্ঞেস করাতে ‘বলাকা’-র কর্মচারীরা আমাদের জানাল যে তাদের একটা মিডি বাস পরদিন সকালেই হোটেলের কিছু কর্মচারী আর ক’’জন পর্যটক নিয়ে গৌহাটি যাবে – আমরা চাইলে তাদের সঙ্গী হতে পারি, তবে অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে।

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের পর তাদের সঙ্গেই আমরা চললাম গৌহাটির পথে কাজিরাঙাকে বিদায় জানিয়ে।

কানহা বান্ধবগড় কাজিরাঙা – সবই অভয়ারণ্য, কিন্তু প্রত্যেকেই নিজস্ব রূপে বিশিষ্ট। এখানে বাঘের দেখা পেলাম না ঠিকই, কিন্তু তার জন্য কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ আমাদের নেই। একাধিক বাঘের দেখা তো আমরা পেয়েছিলাম কানহা বান্ধবগড়ে (আমার ভমণ বৃত্তান্ত-পর্ব ১৫,১৬) – এমনকি তাদের সঙ্গে লুকোচুরিও তো খেলেছিলাম! তাই বাঘের দেখা না পেলেও, যাদের দেখতে এসেছিলাম, সেই – হাতী, গন্ডার, জলা হরিণ ও বুনো মোষ, সবার সঙ্গেই তো আমাদের দেখা হয়েছে। তাই ফিরে চলেছি পরিতৃপ্তি নিয়ে। কাজিরাঙা আমাদের বঞ্চিত করেনি।

— কাজিরাঙা পর্ব সমাপ্ত —
লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. পড়তে খুব ভালো লাগলো। লেখা এতোটাই সাবলীল যে পুরো অভিজ্ঞতাটাই অনুভব করলাম। দারুণ।

  2. Very well written.The excitement of a jungle safari can be felt throughout your writing.ছবিগুলো তো excellent.কাকে credit দেবো জানিনা।খুব ভালো লিখেছ

    1. কোনো credit চাই না । তোমরা পড়েছ, ভালো লেগেছে, তাতেই আমি খুশী ।

Leave a Reply to Ritwick Ray Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!