Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৪০
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৪০

গোপা মিত্র

ভূটান
 
পর্ব-২

নীল আকাশের পটভূমিতে ৭৮৭৩ ফুট (২৪৩০ মিটার) উচ্চতায় পাহাড়ের ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা ভূটানের রাজধানী থিম্পু, অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মাঝে, এক আধুনিক সাজানো গোছানো শহর। নিচ দিয়ে তার বয়ে চলেছে থিম্পু চু আর উপরে তার, পরিচ্ছন্ন মসৃণ রাজপথ, সাজানো বাড়ীঘর, অফিস, পার্ক, দোকান বাজার, হোটেল রেস্তোঁরা – এই সব কিছু নিয়েই ছবির মত সাজানো শহর থিম্পুর রয়েছে এক নিজস্বতা। 

আমাদের মিডি বাস মধ্য দুপুরে এসে থামলো এক জনবহুল রাস্তার উপর ‘সিংগে’ (Syngye) হোটেলের সামনে। একাধিক তলবিশিষ্ট এই হোটেলের নিচের দুটি তলে দোকানের সারি আর উপরের তলগুলিতে থাকার ব্যবস্থা।

আমাদের ঘর চতুর্থ তলে – জানলা খুললেই চোখে পড়ে শুধু চারিপাশের উঁচুনিচু বাড়ীগুলি, তারই ফাঁকফোকর দিয়ে একটু আধটু আকাশ, আর অনেক নিচে রাস্তা দিয়ে মানুষ বা গাড়ীর চলাচল।

দ্বিপ্রাহরিক আহার আজ এখানেই। কিন্তু তার আগেই এদের Reception-এর ফোন থেকে আমরা প্রায় সকলেই আমাদের ফেলে আসা কলকাতার পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, অবশ্যই কিছু অর্থের বিনিময়ে। কয়েকজন অবশ্য এদের কাছ থেকেই কিনে নিল ভূটানের সিম। 

আহারের পর আজ আমাদের Free Time; বদ্ধ ঘরে বসে থাকার চেয়ে বেরিয়ে পড়াই ভাল। যে যার মত আমরা সব বেরিয়ে পড়লাম। হাল্‌কা আরামদায়ক ঠান্ডা মেখে দুপুরের মিঠে রোদে আমরা এগিয়ে চললাম অদূরেই থিম্পুর প্রাণকেন্দ্র ক্লক টাওয়ারের দিকে। 

চারদিকে মুখ করা চারটি ঘড়ি দিয়ে সজ্জিত ক্লক টাওয়ারের সামনে প্রায় চতুষ্কোণ এক প্রশস্ত চত্বর ঘিরে রয়েছে কংক্রীট গ্যালারি, মাঝে তার বাঁধানো এক মঞ্চ। অনেকটা বর্তমানে দার্জিলিং ম্যালে যেমন রয়েছে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত পর্ব-৩১)। মঞ্চে তখন অল্পবয়সী ক’য়েকজন ছেলেমেয়ে গান বাজনার আসর বসিয়েছে। চারপাশের গ্যালারির নরম রোদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা কিছু মানুষ তাদের গান শুনছে, আড্ডা দিচ্ছে  বা আনমনে ইতিউতি চেয়ে চেয়েই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। আমরাও কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে এগিয়ে চললাম। 

ক্লক টাওয়ার ঘিরে রয়েছে একাধিক দোকান, রেস্তোঁরা। দোকানগুলিতে প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সঙ্গেই রয়েছে নানারূপ উপহার সামগ্রীও – তবে সবই প্রায় চীনের তৈরী। এছাড়াও ভূটানী হ্যান্ডিক্রাফ্‌টের কিছু নির্দশনও অবশ্য বিক্রী হচ্ছে। আমরা এক রেস্তোঁরায় প্রবেশ করলাম, আইসক্রীম খেতে। অনেকরকম Flavour-এর আইসক্রীমের মিশেলে চমৎকার সুস্বাদু এক অন্যরকম আইসক্রীম খেলাম। এদের নিজস্ব ভূটানী টাকা ‘ন্যু’ – ভারতীয় টাকার সম মানের। এখানে সর্বত্র ভারতীয় টাকা চললেও – বড় অঙ্কের ভারতীয় টাকা চলে না। আর ন্যু জয়গাঁর কিছু দোকানে বেআইনি ভাবে চললেও ভারতের আর কোথাও কিন্তু চলবে না। ভূটানের জাতীয় ভাষা ‘জাংখা’ হলেও বেশীর ভাগ মানুষ হিন্দী ও ইংরাজীতে স্বচ্ছন্দ। 

যাতায়াতের পথের দুপাশে যেসব বাড়ীঘর দেখলাম তাদের প্রায় প্রত্যেকটির বহিরঙ্গেই রঙ-এর আলিম্পন বা ভূটানের রাজারাণীর রঙীন চিত্র। এরা এদের রাজারাণীকে অসম্ভব শ্রদ্ধা ভক্তি করে – এসব তারই পরিচয়। আরো এক বিস্ময় – এখানের গাড়ী একেবারেই হর্ণ-প্রিয় নয়। রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ীর কাছে দাঁড়িয়ে গেলেই, এরা গাড়ী থামিয়ে দেয়, পার হবার পরই আবার এগিয়ে চলে। রাস্তার মোড়ে পুলিশ থাকলেও এরা সম্ভবতঃ এগুলোই লক্ষ্য করে – রাস্তার নিয়ম কেউ লঙ্ঘন করছে কিনা! এমনিতেও ভূটানের নিয়মকানুন বেশ কড়া। ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্য, পানমশলা বিক্রী, যত্রতত্র থুথু ও আবর্জনা ফেলা, একেবারেই নিষিদ্ধ – ধরা পড়লে জেল বা জরিমানা। এজন্যই হয়তঃ এখানের নাগরিকরা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন, আর ভূটান একেবারেই পরিবেশবান্ধব। হাঁটতে হাঁটতেই পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ভূটানিদের দেখলাম, সকলের পরনেই পা পর্যন্ত ঢাকা জাতীয় পোষাক বাকু বা কিরা। 

পরদিন সকালে জলযোগের পর আমরা চললাম পুনাখা জং বা পুনাখা দুর্গ দেখতে। এই জং বা দুর্গগুলি খ্রিষ্টীয় সতেরো শতকে তিব্বতি আক্রমণ প্রতিহত করতে তৈরী করা হয়েছিল। এগুলো একাধারে যেমন বৌদ্ধ মঠ (মনাষ্ট্রি) তেমনি দুর্গও বটে, যার মধ্যে রয়েছে অস্ত্রাগার, খাদ্যভান্ডার – আপৎকালীন আশ্রয় হিসাবেও এগুলি ব্যবহার হত। ভূটানের প্রায় প্রতিটি মূখ্য জনপদেই এমন একটা করে জং রয়েছে।

থিম্পু থেকে ৭৭ কিমি দূরত্বে পুনাখা জং-এর উচ্চতা ১২০০ মিটার (৩৯০০ ফুট)। ফো চু (পিতা নদী) ও মো চু (মাতা নদী)-র সঙ্গমের মাঝখানে পুনাখা জং-এর অবস্থান এক অনিন্দ্যসুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশে। দুপাশ থেকে বয়ে আসা ফো চু আর মো চুর মিলনে সৃষ্ট পুনাখা চুর তীরবর্তী উর্বর শ্যামল সবুজ উপত্যকায় কিছুক্ষণের জন্য আমাদের আনন্দবিরতি। দূরের পাহাড় তরঙ্গ আকাশে মিশেছে, সামনে শুয়ে আছে নুড়ি পাথরের শ্বেতভূমি – তারই বুক চিরে দূর থেকে বয়ে আসা সবজে নীল জলধারা পায়ের কাছে এসে হারিয়ে যাচ্ছে ঘন নীলের মধ্যে। তারপর সবটুকুর একই রঙ, একই চলা, একই ছন্দ –  কোনটি ফো চু আর কোনটিই বা মোচু!

এবার এগিয়ে চলা জং অভিমুখে। আগেই অবশ্য পেরিয়ে এসেছি ফো চু, মো চুর উপর অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন, ঝুলন্ত এক কাঠের সেতু। অনবদ্য এই সেতুটি ভূটানের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু। মাথায় আচ্ছাদন থাকলেও, উন্মুক্ত দুপাশের মধ্যে দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় সুদূরে – আকাশ পাহাড় অরণ্য আর নদীর এক অপরূপ মেলবন্ধন। চারিদিকের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমি আনমনে কখন যেন অন্যপারে পৌঁছে গেলাম। 

সামনেই দণ্ডায়মান লাল সাদা মেরুণ হলুদ কন্‌ট্রাষ্টে সেজে ওঠা বিশাল পুনাখা জং। বিভিন্ন প্রজাতির বর্ণময় পুষ্পশোভিত উদ্যানের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেলাম তার বিশাল প্রবেশ তোরণে। ১৬৩৭-৩৮ খ্রীঃ প্রথম জাহাবদ্রুং রিনপোচে নির্মিত রাজকীয় এই জংটি ভূটানের দ্বিতীয় প্রাচীন ও দ্বিতীয় বৃহত্তম।

মাটি থেকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে জং-এর অলিন্দ পর্যন্ত। অত্যন্ত সাবধানে সিঁড়ি উঠতে হয়। বাইরে থেকে অন্দরে আসতে গেলে কিছুটা অন্ধকার অংশ পেরোতে হয়। ভিতর যেন এক গোলক ধাঁধাঁ। কোথা থেকে যে কোথায় যাব বোঝা দায়। আমরা সকলেই তাই দলবদ্ধভাবে এগোলাম। অন্দরে, উপরের সিলিং-এ কাঠের নক্‌শা করা পাটাতনগুলোয় রঙের আলিম্পন। দেয়ালভরে বৌদ্ধকলার বিচিত্র সব ছবির সমারোহ চোখ ধাঁধিঁয়ে দেয় তাদের বর্ণ বৈচিত্রে। কি আশ্চর্য এর গঠনশৈলী। কোথাও দরজা, কোথাও ঝুল বারান্দা, কোথাও কার্ণিশ, কোথাও থামের বাহার আবার কোথাও বা দেওয়াল চিত্র – সব জায়গাতেই রঙের বিস্ফোরণ।

একাধিক তলবিশিষ্ট শক্ত মাটি (Compacted Earth), পাথর ও কাঠের তৈরী এই জংএ রয়েছে তিনটি বিরাট উঠোন এবং প্রতিটি উঠোন সংলগ্ন একটি করে ঘরদালান বা টাওয়ার। প্রবেশের পর প্রথম উঠোনের মাঝখানে রয়েছে ধব্‌ধবে সাদা এক চোর্তেন, বাঁধানো এক বৃক্ষ (সম্ভবতঃ বোধিবৃক্ষ) মঞ্চ। এদের ঘিরে বৌদ্ধিক শৈলীর কারুকলায় সজ্জিত ঘরদালান, মূর্তি, থাংকা, বুদ্ধজীবনী বর্ণণায় রঙীন মূর‍্যাল ছাড়াও রয়েছে বজ্রযানী দেবদেবীর নানা মূর্তি ও পটচিত্র। এক দালান থেকে অন্য দালানের উঠোন চত্বরে যাওয়ার জন্য পেরোতে হয় অন্ধকার গলিপথ। মাঝদালান সন্ন্যাসীদের বাসস্থান। একেবারে পিছন দিক থেকে দেখা যায় তরঙ্গায়িত গিরিশ্রেণী, তাদের ঢাল বেয়ে নেমে আসা সবুজ বনাণী, আর সঙ্গে চলা নীল নদী। পুনাখা যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য মেলে ধরেছে এখানে।  

দ্বিপ্রহরের আহার বিরতির পরে আবার এগিয়ে চলা দোচুলা পাসের পথে। থিম্পু থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে ১০২০০ ফুট উচ্চতার দোচুলা পাসের মাঝখানে বাঁধানো ফাঁকা এক বিরাট চত্বরে সাজানো ১০৮টি ছোট ছোট চোর্তেন বা স্তূপ – ড্রুক ওয়াংগিয়াল কাংজাং চোর্তেন। দেশের রাজার সম্মানার্থে নির্মিত এই চোর্তেন।

বাঁধানো উঁচু নিচু চত্বরের চারিপাশে কুয়াশায় ডোবা পাইনের সারি। আরো উপরে রয়েছে এক মনাষ্ট্রি। সিঁড়ি বেয়ে সেখানে ওঠার পথের পাশে তখন লাল গোলাপী পুষ্পিত রডোডেনড্রনের যেন আলোর হাতছানি। বেশ কিছুটা ওঠার পরে পৌঁছে গেলাম সেই সুন্দর মনাষ্ট্রিতে। দেওয়াল জুড়ে আঁকা রঙ বেরঙের চিত্রাবলীতে রাজারাণী ও রাজবৈভবের প্রদর্শন। অন্যান্য মনাষ্ট্রির মতই অন্দরে তথাগত বুদ্ধের সোনালি মূর্তি – চারিদিকের থাংকাবাহারে রঙের ছটা। 

মনাষ্ট্রির উপরের ভিউ পয়েন্ট থেকে ভূটানের প্রায় সমস্ত তুষারাবৃত শৃঙ্গমালাই একসঙ্গে দৃশ্যমান, শুনেছিলাম। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, দোচুলায় এসেও দেখা হল না মেঘ কুয়াশায় আবৃত অসাধারণ সেই শৃঙ্গমালা, এমনকি চোমলহরিও রয়ে গেল অধরা; শুধু চোখে পড়ল আশপাশের পাহাড়গুলোয় ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ন্ত রঙ বেরংএর প্রার্থনা পতাকাগুলি। দোচুলা পাস থেকে একটি রাস্তা রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে দিয়ে নেমে গেছে ফোবজিকা ভ্যালীর দিকে। আমরা অবশ্য সেদিকে না গিয়ে ফিরে চললাম থিম্পুর দিকে, পুরোন পথে।

পরদিন সকালে আমাদের প্রথম গন্তব্য লেড়কী লাকাং নাকি লাকী লাকাং। এক চত্বরের মাঝে অবস্থিত এই মনাষ্ট্রির কাঠের সিড়িঁ দিয়ে দোতলায় উঠে প্রবেশ করলাম গর্ভগৃহে। দেখলাম কয়েকজন ভূটানি মহিলা, তাদের কয়েক মাসের বাচ্চা কোলে অন্দরে উপস্থিত ভগবানের আশীর্বাদ নিতে – আমরা যেমন মন্দিরে আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে যাই ভগবানের আশীর্বাদ লাভের জন্য।  

এখান থেকে আমরা চললাম বুদ্ধ পয়েন্ট বা বুদ্ধ দোর্দেনমা। গাড়ী শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। তারপর যেখানে থামল, সেখান থেকে বেশ কিছুটা উপরে উঠে দেখলাম, পাহাড় চূড়ায় পায়েসের বাটি হাতে উপবিষ্ট ১৬৯ ফুট (৫২ মি) উচ্চতার বিশালাকায় শাক্যমুনি বুদ্ধের সোনালী মূর্তি। তার নিচে বাঁধানো বিরাট চত্বরের পার্ক পর্যটকদের বিশ্রামস্থল। শুনলাম এই বুদ্ধমূর্তি থিম্পুর প্রায় সর্বত্র থেকেই দৃশ্যমান। আমরাও সেই উপর থেকে পাখীর চোখে দেখে নিলাম থিম্পু শহরের রঙবেরং এর খুদে খুদে খেলনার মত বাড়ীঘর ও রাস্তাগুলি।

এরপর আমরা চললাম ভূটানের জাতীয় পশু ‘টাকিন’ দর্শনে ‘মোহিথাং টাকিন সংরক্ষণ কেন্দ্র ও চিড়িয়াখানা’য়। গাড়ী যেখানে আমাদের নামাল, সেখান থেকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে অনেকটা উপরে উঠতে হল আমাদের। পাহাড়ের গায়ে জাল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট এই চিড়িয়াখানায় রয়েছে কয়েকটি হরিণ, পাহাড়ী ছাগল আর অদ্ভূত দর্শন বেশ কয়েকটি জীব – টাকিন, গরু আর ছাগলের মিশ্র প্রজননে সৃষ্ট।

শহরে ফিরে, আমরা একে একে ঘুরে দেখলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরী, টেক্সটাইল মিউজিয়াম, ও হ্যান্ডিক্রাফট মার্কেট। ন্যাশনাল লাইব্রেরীর কাছেই রঙবেরঙের প্রস্ফুটিত পুষ্প সম্ভারের মধ্যমণি, মৃদুমন্দ হাওয়ায় আন্দোলিত উজ্জ্বল হলুদ পপি ফুলগুলো মাথা ঝাঁকিয়ে যেন আমাদের অভিবাদন জানিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্দেশ করল। তাদের পাশেই সাজান ভূটানের বিচিত্র দর্শন মুখোশের সারি, বিক্রীর অপেক্ষায়। 

ন্যাশনাল লাইব্রেরীর কাছেই টেক্সটাইল মিউজিয়ামে রয়েছে ভূটানের প্রাচীন ও বর্তমান বস্ত্রশিল্পের নানা নিদর্শন। এই মিউজিয়ামে যেমন চলে বয়নশিল্পের পঠনপাঠন ও রিসার্চ, তেমনই চলে ভূটানের ঐতিহ্যশালী বস্ত্রশিল্পের জনসমক্ষে প্রদর্শন। 

হ্যান্ডিক্রাফট মার্কেট অনেকটা আমাদের শান্তিনিকেতনের হাটের মত। ছোট ছোট ষ্টলগুলিতে কুটীরশিল্পের নানা সৌখীন ঘর সাজানোর ও উপহার সামগ্রী বিক্রী হচ্ছে। ফেব্রিকের কাজ করা রঙচঙে সুন্দর সুন্দর বস্ত্রসম্ভারগুলি বা কারুশিল্পের নিদর্শনগুলি খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু তাদের মূল্য আকাশছোঁয়া। 

সবশেষে আমরা দেখলাম ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন বা থিম্পু চোর্তেন। আধুনিক ভূটানের জনক তৃতীয় রাজা ড্রুক গেলপো জিগমে দোরজি ওয়াংচুক এই মনুমেন্ট তৈরীর পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্ন তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণ না হলেও পরবর্তী রাজপরিবার তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মনুমেন্ট তৈরী করান। অন্যান্য স্তুপের মত এখানে কোন দেহাবশেষ নেই- রয়েছে রাজকীয় পোষাকে সজ্জিত গেলপোর চিত্র। সোনালী ঘন্টা ও চূড়া সমন্বিত এই চোর্তেন বলা যায় ভূটানের ল্যান্ডমার্ক। 

দেখলাম, চাংলি মিথান – ভূটানের খেলার মাঠ ও ষ্টেডিয়াম। শুধুমাত্র ফুটবল খেলাই নয়, বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতাও হয় এই ষ্টেডিয়ামে। পাশেই মাঠে দেখলাম তখন চলছে তীরন্দাজীর অনুশীলন – অনেক দর্শকই সেখানে উপস্থিত। আমরাও সেখানে বসে গেলাম তাদের সঙ্গে।

আঁধার ঘনাতেই বিষাদে ভরে গেল মন। কাল ভোরেই ভূটানের সুখসঙ্গ পরিত্যাগ করে পাড়ি দিতে হবে কলকাতার উদ্দেশ্যে। এটাই তো জীবন। থেমে থাকার কোন জায়গাই নেই। মনে রয়ে যাবে ভূটানের অতুলনীয় পুষ্পসম্ভার, অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি, অমলিন সৌন্দর্য, তবে সঙ্গে একটা প্রশ্নও অবশ্য রয়ে যাবে, আমরা কেন আমাদের দেশের প্রকৃতি রক্ষায় যত্নবান নই বা সৌন্দর্য রক্ষায় সচেষ্ট নই ? পড়শী দেশ ছোট্ট ভূটান যা পারে, আমরা কেন তা পারি না!

— ভূটান পর্ব সমাপ্ত —
লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব ভালো লেখা। পড়ে আনন্দ উপভোগ করলাম।
    ছবিগুলো দারুণ।।💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐

  2. তুমি যা লিখেছ তাতে তো মনে হচ্ছে ভূটান একটি দারুন সুন্দর জায়গা।ছবিগুলোর সাথে তোমার বর্ণনা গুলো মিলে যাচ্ছে।খুব সুন্দর লিখেছ।

    1. শুধু মাত্র সুন্দর নয়, পরিচ্ছন্নও বটে ! পড়েছ বলে অনেক ধন্যবাদ ।

Leave a Reply to Runa Ray Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!