Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২২
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২২

গোপা মিত্র

লোলেগাঁও  রিশপ  লাভা

।। শেষ পর্ব ।।

(লাভা)

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার কালিম্পং সাবডিভিসনের এক ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম লাভার উচ্চতা ৭২০০ ফুটের কিছু কম। কালিম্পং থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিলো মিটার। নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ দ্বার এই লাভা। অবশ্য এই উদ্যানে প্রবেশের জন্য আগে থেকেই অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়।

এবার চলেছি লাভার পথে। সেই একইরকম পাহাড়ী পাকদন্ডী, তবে এবার উৎরাই পথে। গাড়ী এবার ক্রমশঃ নিচে নামছে। দূরত্ব বেশী নয়, সময়ও বেশী লাগে না। চারিপাশের জঙ্গলঘেরা পথ পার হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম লাভা। ভূটানি ভাষায় ‘লা’ শব্দের অর্থ ভগবান আর ‘ভা’ শব্দের অর্থ উপস্থিতি। এখানকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস ভগবানের আশীর্বাদেই এখানের প্রকৃতি এত সুন্দর, সবুজ। ভগবান যেন এখানের প্রকৃতি নিজ হাতেই সাজিয়েছেন, তাই এখানের চারিপাশে যেমন রয়েছে পাহাড় তেমনই অরণ্য। পাইন, ফার, বার্চ, গাছের জঙ্গলে সারাদিনই চলে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি, নীল আকাশে সর্বক্ষণই চলে মেঘের আনাগোনা।

আমাদের বুকিং, ওয়েষ্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের, লজের গেটে পৌঁছে মন খারাপ হয়ে গেলো – দেখলাম গেটের পাশেই বেশ বড়ো Reception Officeএর পুড়ে যাওয়া অবশেষ। এখন Reception-এর কাজ চলছে ভিতরের Dining Hall থেকে। তাদের বুকিং রিসিপ্ট দেখাতে তারা আমাদের পাশাপাশি দুটি চমৎকার আটকোনা কটেজ দেখিয়ে দিলো। দূরের পাহাড় আর চারিপাশের গাছপালার মধ্যে কটেজগুলির অবস্থান বড়োই সুন্দর – বেশ অনেকখানি জায়াগা, শীতের মরশুমী ফুল দিয়ে সাজানো বাগান, মাঝে মাঝেই কোনো পাখীর ডাক বা প্রজাপতির ওড়াঊড়ি। এই Complex-এর মধ্যে পাহাড়ের কয়েক ধাপ নিচেই ঘন গাছপালার মধ্যে রয়েছে আরো এক Set Cottage; সব মিলিয়ে খুবই চমৎকার।

আমরা কটেজে মালপত্র রেখে বেরোলাম লাভা দর্শনে। কল্যাণ রইলো বিশ্রামে – আমরা তিনজনে চললাম লাভার অন্যতম দ্রষ্টব্য Nature Interpretation Centre-এ। বেশ ভালো বাঁধানো রাস্তা। একটু নিচে নেমে আমরা এগিয়ে চললাম সেই রাস্তা ধরে ডান দিকে। একটু এগিয়েই Centre, কিন্তু চাবি বন্ধ। Caretaker চাবি দিয়ে কাছাকাছি কোথাও গেছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞস করে তার হদিস জেনে তাকে ডেকে এনে দরজা খোলালাম। তারপরে অবশ্য সে আমাদের বেশ ভালো করে সব ঘুরিয়ে দেখালো।

লাভা জীপ ষ্ট্যান্ড থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে ঋষি রোডের উপর অবস্থিত এই মিউজিয়ামটি নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যানের বনভূমি ও বন্য প্রাণীদের চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছে। বনবিভাগ দ্বারা পরিচালিত এই Centre-টি অরণ্যপ্রেমীদের মুগ্ধ করবেই। ভিতরে কৃত্রিম ভাবে বনসৃজন করে তার মধ্যে রাখা রয়েছে বন্য প্রাণীদের ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখীদের ষ্টাফড মডেল ও ছবি। চারিদিকের ছড়ানো মডেল, গাছপালা ও দেওয়ালচিত্রের মধ্যেদিয়ে যেতে যেতে মনে হয় আমরা যেন সত্যিই এক বনের মধ্যে রয়েছি – প্রায়ান্ধকার কৃত্রিম গুহার মত ঘরগুলি এমনই মায়াময় এক বন্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে নানারকম অর্কিড আর ফুলের সমারোহ।

লজে ফিরে দুপুরের আহারান্তে আমরা আবার বার হলাম লাভার গুম্ফা দর্শনের জন্য। তার আগে অবশ্য Reception থেকে জেনে নিয়ে পরদিনের, ছাঙ্গে ফল্‌স যাবার জন্য, জীপ ষ্ট্যান্ড থেকে জীপের বুকিংও সেরে নিলাম।

খানিকটা এগিয়ে পৌঁছলাম এক বাজার এলাকায় – বেশ বড়োবড়ো দোকান রয়েছে সেখানে। সামনেই এক বেঞ্চিপাতা রেলিংঘেরা প্রশস্ত চত্বর – কিছু লোক সেখানে বসে শীতের রোদ উপভোগ করছে। আমরাও কিছুক্ষণ সেখানে বসলাম, তারপর পাশেরই এক পাহাড়ী ঢালু রাস্তা ধরে নেমে চললাম নিচে। বেশ খানিকটা নামার পর পৌঁছে গেলাম সবুজ পাহাড়ের গায়ে ছবির মত সেই গুম্ফার সামনে। পাহাড়ের পটভূমিকায় অবস্থিত এই গুম্ফাটি থেকে তুষারাবৃত গিরিশ্রেণীর সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে মেঘের কারণে সে দেখার সৌভাগ্য আর আমাদের হলো না। বিশাল জংটি উজ্জ্বল রঙে রঙীন, ইঁট ও কংক্রীটে তৈরী। এই জংটির ভিতরে রয়েছে একটি বড়ো ও একাধিক ছোটোছোটো বুদ্ধ মূর্ত্তি। অন্দর সাজানো নানারকম ফ্রেস্কো দিয়ে। বাইরে রয়েছে সারিবদ্ধভাবে সাজানো প্রেয়ার হুইলগুলি। ভূটানি লামারা এখানে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে।

পরদিন হাল্কা আহার শেষে, তাড়াতাড়ি চললাম ছাঙ্গে ফল্‌স দেখতে। লাভা থেকে ১৪ কিলোমিটার আর কোলাখাম থেকে ৪ কিলোমিটার দূরের এই ফল্‌সের রাস্তা গিয়েছে নেওড়া ভ্যালীর পাশ দিয়ে কোলাখাম হয়ে। দুদিকের সবুজ আর নির্জন প্রকৃতি সঙ্গী করে আমরা এগিয়ে চলেছি। বেশ কিছুদূর পরই গাড়ী লাফাতে লাগলো – এতই খারাপ রাস্তা। চারিপাশের গাছপালার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোনোরকমে একটা জীপই শুধু যেতে পারে। ঝাঁকুনি খেতে খেতে ধূলো উড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। অবশেষে গাড়ী থামলো। কিন্তু ফল্‌স কোথায়? আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অযত্নবর্ধিত গাছপালার জঙ্গলের মধ্যে। ড্রাইভার আমাদের বললো যে গাড়ী আর যাবে না, এই রাস্তা ধরে আরো কিছুদূর গেলেই আমরা ফল্‌সে নামবার সিঁড়ি দেখতে পাবো।

সেই উঁচু নিচু রাস্তা ধরে হোঁচট খেতে খেতে আমরা কোনোরকমে এগিয়ে চললাম। প্রায় এক কিলোমিটার পরে এক চৌকোনা রেলিং ঘেরা বাঁধানো জায়গা দেখতে পেলাম। সেখান থেকে বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। তখনও অবশ্য ফল্‌সের চিহ্নমাত্র দেখছি না, কানে আসছে শুধু জলের ঝরঝর শব্দ।সিঁড়ির বাঁকের সঙ্গে বাঁক নিতে নিতে রেলিং ধরে ধরে আমরাও পৌঁছে গেলাম নিচে। তারপরই চোখে পড়লো, পাহাড় আর ঘন জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মনোমুগ্ধকর এই অতুলনীয় ঝর্ণার জমকালো সৌন্দর্য। প্রায় ১৫০ ফুট উপর থেকে তীব্র বেগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এর জলধারা স্ফটিক স্বচ্ছ; কিন্তু নিচে যেখানে বা যে খাদে সে পড়ছে সেখানে তার রঙ্‌ পান্না সবুজ।

সিকিমের পেলিং-এও রয়েছে এক ছাঙ্গে জলপ্রপাত (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – পর্ব ১৮); সেও অবশ্য চমৎকার। তবে লাভার এই জলপ্রপাত আমার অনেক বেশী নয়নমনোহর বলে মনে হয়েছে। চারিদিকের গভীর অরণ্য আর পর্বতবেষ্টনীর মধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা, এই ঝর্ণার চর্তুদিক ব্যপ্ত অনন্ত অপার নৈঃশব্দের মাঝে নিরবছিন্ন ভাবে ঝরে পড়া জলের ঝর্‌ঝর্‌ শব্দ আর পাখীদের চির্প-চির্প ডাক – প্রকৃতির দুই বিপরীত ধর্মী রূপ, শব্দ আর নৈঃশব্দের মেলবন্ধনেই যেন এখানের প্রকৃতি পেয়েছে পূর্ণতা। এমন কি আমি আগে কোথাও দেখেছি?

পাহাড়ের কোলে অবস্থিত লাভা যেন এক মেঘের রাজ্য। মাথার ওপরে নীল আকাশের বুকে সারাদিনই ভেসে চলে মেঘের ভেলা, পায়ের নিচে সবুজ বনপথে চলে রৌদ্রছায়ার আঁকিবুকি আলপনা, আর চোখের সামনে মেঘের আঁচলে মুখ ঢেকে লুকিয়ে থাকে দূরের ঐ পাহাড়ের সারি – এ সবই লাভার বৈশিষ্ট্য। এই সব কিছু সঙ্গে নিয়েই বনপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখনো হয়ত মনে হয় কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নিলে ভালো হয় –ঠিক তখনই কানে আসে কোনো এক অচেনা পাখীর ডাক। বসা আর হয় না, বনমধ্যে চলে তখন তাকে খোঁজার চেষ্টা। এভাবেই সকাল গড়িয়ে বিকেল নামে, আমরাও ফিরে আসি কুলায়।

কিন্তু লাভার রয়েছে এক অভাবও। এখান থেকে সরাসরি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না। তার জন্য যেতে হয় এখান থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে টিফিনদাঁড়া পাহাড়ের চূড়ায়। দুপাশের বনভূমির মধ্যে দিয়ে সরু পাহাড়ী চড়াই পথে পৌঁছতে হয় পাহাড় চূড়ায়। যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় দেড় দুঘন্টা, পুরোটাই পায়ে হেঁটে। রিশপ থেকে এই টিফিনদাঁড়ার দূরত্ব অবশ্য ২ কিলোমিটার। এখান থেকে মেঘমুক্ত আকাশে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার ধ্যানগম্ভীর মহামহিম রূপ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার – মেঘের রাজ্য লাভায় আমরা আর সে চেষ্টা করলাম না।

কাল ফিরে যাবো কলকাতায়। সন্ধ্যায় দেখি ঐ Complex-এর মধ্যেই কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে Bon Fire-এর আয়োজন করেছে। তাদের আমন্ত্রণে আমরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লাভাকে বিদায় জানাবার প্রস্তুতি সেরে নিলাম।

লোলেগাঁও, রিশপ, লাভা এদের একইরকম শান্তসমাহিত সৌন্দর্য আমার অনুভবে এসেছে তিনভাবে। লোলেগাঁওএর অপার নৈঃশব্দ অশান্ত মন শান্ত করে নতুন জীবনীশক্তি ফিরিয়ে দেয়, রিশপের ধ্যানগম্ভীর মগ্নতা নিজের সঙ্গে নিজেকেই কথা বলায় আর মেঘের আবরণ উন্মোচিত লাভায় পাখীর কূজন কানে নিয়ে বনপথে হাঁটতে হাঁটতে অর্গলমুক্ত মন নিজেকেই চিনতে শেখায়।

পরিশেষে, আশা করি এতদিনে হয়ত লোলেগাঁও-এর পুড়ে যাওয়া ভেঙে যাওয়া লজটি বাসের উপযুক্ত হয়েছে, ক্যানোপিও হাঁটার জন্য তৈরী, লাভাও ঠিকঠাক। এখন নিশ্চয় আরো বেশী প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকরা এ সব জায়গার কোলাহলমুক্ত নির্জনতায়, দূষণমুক্ত পরিবেশের বিশুদ্ধ হাওয়ায় নিজেদের উজ্জীবিত করে নতুন উদ্যমে নিজেদের কাজের জায়গায় ফিরে আসতে পারবে।

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. সুন্দর। পরবর্তী ভ্রমণ বৃত্তান্তের অপেক্ষায় রইলাম।

      1. অসাধারণ লেখা। তুমি এতো পুরোনো স্মৃতিগুলো এইরকম পুংখানুপুংখ ভাবে মনে রাখো কি করে বলোতো? দারুণ।

        1. মনের মধ্যে ভালোলাগার যে ছবিগুলো রয়ে গিয়েছিল , সেগুলো কেই লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি ।

  2. গভীর অধ‍্যবসায় না থাকলে এইরকম সুন্দর প্রাণবন্ত লেখা সম্ভব নয়। শুধু একটা দুটো নয়….বাইশটা পর্ব।
    অভিনন্দন জানাই।💐💐💐💐

  3. সত্যি তুমি কি ভাবে পারছো একই standard ধরে রাখতে।প্রতেক টা লেখা এতো সুন্দর।ছবিগুলো খুব পরিষ্কার আর দারুণ।।খুব ভালো হয়েছে ।

    1. শুরু করেছিলাম একজনের আগ্রহে , এখন এগিয়ে চলেছি তোমাদের সকলের উৎসাহে ।

Leave a Reply to গোপা মিত্র Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!