Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৫
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৫

গোপা মিত্র

এবার অরণ্যে – বান্ধবগড় ও কান্‌হা

।। প্রথম পর্ব ।।

একটু এগিয়েই আমাদের হাতিকে থামিয়ে দিলো মাহুত। পাশের ঘাসজমিতে তখন চরে বেড়াচ্ছে একঝাঁক চিত্রবিচিত্র হরিণ। আমরা থামলাম – তাদের দেখতে, ছবি তুলতে। কিন্তু তাদের কোনোও হেলদোল নেই – তারা যেমন চরছিলো, তেমনই রইলো। কারণ তারা জানে, এ অরণ্য হলো তাদের জন্য।

এ এক সংরক্ষিত জাতীয় অরণ্য।

সে সময়ে ১৯৯০ সালে, M. P. Tourism একটা জঙ্গল সাফারি করাচ্ছে। “Call of the Wild”। তারা নিয়ে যাবে বান্ধবগড়, কান্‌হা ও জব্বলপুর। সাতদিনের ট্যুর। সব ব্যবস্থা ওদের। ট্রেনের টিকিটও ওরাই কেটে দিয়েছে। আমরা শুধু টাকা দিয়েই নিশ্চিন্ত। তবে আমাদের প্ল্যানটা একটু অন্যরকম ছিলো। অতোদূর যাচ্ছি যখন, তখন পাঁচমারি আর খাজুরাহো আমরা বেড়িয়েই ফিরবো। সেইমতো আমরা ফেরার টিকিট কেটে নিলাম।

এর আগে আমি কোনোও অরণ্য ভ্রমণে যাইনি। তাই এবার আমি খুবই উত্তেজিত। কল্যাণের বন্ধু শঙ্করের পরামর্শেই আমাদের এই ভ্রমণ। ক’দিন আগেই সে এই ট্রিপটা করে এসেছে। সাদা বাঘ, হলুদ বাঘ (রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার) সবই সে দেখে এসেছে। শঙ্কর আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, আমরাও নিশ্চয়ই বাঘ দেখতে পাবো। তার বিশ্বাস যে এভাবে সত্যে প্রমাণিত হবে, আমি তখনও ভাবতেই পারিনি। শঙ্করের আরোও একটা সঠিক পরামর্শ অবশ্য ছিলো – সে বলেছিলো যেতে হলে এখনই অর্থাৎ এপ্রিল/মে মাসেই যেতে হবে। কারণ, এ সময়ে বাঘেদের মিলন সময়। তাই তারা অনেক সময়ে নিজেদের ডেরার বাইরে বেরিয়ে আসে। এই ‘মিলন সময় থিওরি’-র সত্যতা অবশ্য আমার জানা নেই। তখন যা শুনেছিলাম, তেমনই লিখলাম।

প্রথমেই বান্ধবগড়। মধ্যপ্রদেশের একেবারে উত্তর সীমান্ত ঘেঁষা বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের গা ছুঁয়ে গড়ে ওঠা উমারিয়া জেলার বান্ধবগড়ের বিস্তার ১,১৬১ বর্গ কিলোমিটার হলেও এর Core Zone বা জঙ্গল এলাকা মাত্র ৬২৪ বর্গ কিলোমিটার। বাকিটা Buffer Zone। কিন্তু Coverage এলাকা আরোও কম – মাত্র ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৬৮তে জাতীয় উদ্যান ও ১৯৯৩ সালে এটি Tiger Reserve-এর তকমা পায়। বেড়াবার সময়, মধ্য অক্টোবর থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত। বাকি সময়ে অর্থাৎ বর্ষায় অরণ্য বন্ধ থাকে।

শঙ্করের পরামর্শ মাথায় রেখেই এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে এক প্রায় বিকেলে কলকাতা থেকে ট্রেনে আমরা এসে পৌঁছলাম মধ্যপ্রদেশের সাতনায়। স্টেশনেই M. P. Tourism-এর এক কর্মকর্তা আমাদের নিতে উপস্থিত। আমাদের সঙ্গে যাঁরা যাবেন, তাঁরাও তখন পৌঁছে গিয়েছেন। আমরা মোট দশজন – আমি, কল্যাণ, সোনাই ও বাইরে থেকে আসা আরোও সাতজন স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম, আমাদের জন্য এক ‘অলউইন নিশান’ ওমনিবাস অপেক্ষা করছে। কর্মকর্তাটি, উনিই আমাদের ম্যানেজার – প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উনিই আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং এই ওমনিবাসেই আমরা পুরো সফরটাই সম্পন্ন করেছিলাম। অবশ্য অরণ্য সফরে বনের যেখানে যেমন দরকার – জীপ বা হাতি – সে ব্যবস্থাও ট্যুরিজমই করেছিলো। বলা যায় একেবারে সর্বাঙ্গসুন্দর ব্যবস্থা।

স্টেশন থেকে মালপত্র সমেত প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো, ট্যুরিজমের এক হোটেলের রেস্তোরাঁয়। সেখানে সকলে হাত-মুখ ধুয়ে অল্প বিস্তর ফ্রেশ হওয়ার পর চা আর পকৌড়া পরিবেশিত হলো। এখানেই আমি প্রথম ফুলকপির পকৌড়া খেয়েছিলাম।

চা-পর্ব শেষ হলে ওমনিবাস আমাদের নিয়ে রওনা দিলো বান্ধবগড়ের দিকে। বান্ধবগড়ের প্রবেশদ্বার ‘টালা’ – সাতনা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো। আমাদের থাকার ব্যবস্থা মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের ‘White Tiger Forest Lodge” একেবারেই বনের মধ্যে। কটেজের কাছেই Dining Hall। নৈশাহারের পরে ম্যানেজার আমাদের সকলকেই সাবধান করে দিয়ে বললেন, রাতে কোনোওমতেই যেন আমরা যে যার কটেজের বাইরে পা না দিই। আমরা সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম।

পরদিন ভোরে তৈরী হয়ে বাইরে এসে চারিদিক ভালো করে দেখলাম। চমৎকার কটেজ। প্রায় দ্বিতল সমান উচ্চতায় সার সার সিমেন্টের থামের ওপর বৈদিক যুগের কুটিরাকৃতি কটেজ – চারপাশের ঘন অরণ্যাণীর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। কটেজগুলির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্যাসেজ ও সিঁড়ি পুরো কাঠের তৈরী। কটেজের অভ্যন্তরে আধুনিক যুগোপযোগী স্বাচ্ছন্দ্যের সমস্ত ব্যবস্থাই মজুত। আর সবচেয়ে ভালো লাগলো, ঠিক পিছনেই রয়েছে এক ফুলন্ত পলাশগাছ।

চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা সবাই তৈরী হয়ে এসে উপস্থিত হলাম আমাদের সেই ওমনিবাসের কাছে। বেরোবার আগে ম্যানেজার আমাদের কয়েকটা ব্যপারে সতর্ক করে দিলেন। উনি বললেন মনে রাখতে হবে যে, অরণ্য বন্য জীবজন্তদের বাসস্থান। কাজেই কোনোওভাবেই ওদের অসুবিধা বা বিরক্ত করা যাবে না। বনে কোনোও রকম চিৎকার করে কথা বলা চলবে না। যদি কোনোও বন্যপ্রাণী আমাদের সামনে চলে আসে, ততোক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, যতোক্ষণ না তারা চলে যায়। অধৈর্য হলে চলবে না। বনে কোনোওরকম ধূমপান, আগুন জ্বালানো বা ফ্ল্যাশলাইটে ছবি তোলা চলবে না। আর সবশেষে বললেন যে, জঙ্গলে কোনোওরূপ খাদ্যবস্তু নিয়ে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বান্ধবগড়ে এক টিলার ওপর রয়েছে বহু প্রাচীন এক দূর্গের ধ্বংসাবশেষ। পুরাণমতে এই দূর্গের নির্মাতা শ্রী রামচন্দ্র এবং তিনি এটি তাঁর ভাই লক্ষ্মণকে উপহার দিয়েছিলেন – সেই থেকেই নাম বান্ধবগড় (বান্ধব = ভাই, গড় = দূর্গ)। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজবংশের দখলে আসে এই দূর্গ। পরে এটি রেওয়ার রাজার শিকারক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং এখানেই প্রথম সাদা বাঘ দেখা যায়।

‘অলউইন নিশান’ আমাদের পৌঁছে দিলো একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। এবার আমাদের হাতির পিঠে সওয়ার হতে হবে। এর জন্যে আমাদের ওমনিবাসের ছাদে উঠতে হলো। হাতি তার পাশে এলে আমরা ওমনিবাসের পেছনে লাগানো সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে হাতির পিঠে চেপে বসলাম। পিঠোপিঠি বসা – একটায় চারজন অন্যটায় ছ’জন। সামনে একজন করে মাহুত। ম্যানেজার আমাদের বললেন যে, মাহুত আমাদের যেমন বলবে, আমরা যেন তেমন ভাবেই চলি।

জঙ্গলে শাল ও বাঁশ গাছের প্রাধান্য। তাদের কোলে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি বা তৃণভূমি। বেশ কিছু অঞ্চল আবৃত তিন/চার ফুট উঁচু ঘাসে। এই ঘাসের এক বিশেষ নাম আছে – হাতিঘাস বা Elephant Grass। বাঘ লুকিয়ে থাকবার আদর্শ জায়গা এই ঘাসবন। চারিপাশ সবুজে সবুজ। মাঝেমধ্যেই রয়েছে জলাশয় বা সোঁতা। জলাশয়গুলির ধারে জীবজন্তু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

আমাদের হাতির অবশ্য কোনোও দিকে হেলদোল নেই। সে আমাদের পিঠে নিয়ে মাহুতের নির্দেশে গাছপালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে বা কখনোও সেই হাতিঘাস মাড়িয়েই গজেন্দ্রগমনে এগিয়ে চলেছে। আমাদের হচ্ছে প্রাণান্ত – মাথায় যাতে গাছপালার ঠোক্কর না লাগে সেই জন্যে আমাদেরই মাথা বাঁচিয়ে যেতে হচ্ছে।

প্রথমেই চোখে পড়লো একঝাঁক হরিণ – খেলে বেড়াচ্ছে ঘাসজমিতে। ভোরের আলোয় তাদের গায়ের বাদামী রং চকচক করেছে। যেন তেল মেখেছে। তারই ওপর সাদা রঙের বুটি – Spotted Deer বা চিতল হরিণ। মাহুত হাতি দাঁড় করিয়ে আমাদের ছবি তোলবার সুযোগ করে দিলো। আবার এগোলাম – সম্বর, চার শিং বিশিষ্ট হরিণ চৌশিঙা, নীলগাই – ছবি তো তুলছি, কিন্তু যা দেখতে এসেছি সেই সাদা বাঘ কোথায়?

হঠাৎ তড়িৎগতিতে দৌড়ে এলো – ওটা কি? একটা চিতা। লক্ষ্য পাশের এক হরিণের পাল। তারপর দেখলাম সেই দৃশ্য – হরিণগুলো যে যেদিকে পারলো পালালো আর পিছনে সেই চিতা গাছপালার জঙ্গলে ঢুকে গেলো, তাদের পিছু ধাওয়া করে। পাশ দিয়ে উঁকি মারলো কালো রঙের এক বন্য বরাহ – দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে মুখের দু’পাশ থেকে।

চারিদিক থেকে ভেসে আসছে পাখীর কলকাকলি। কিন্তু হাতি থামিয়ে যে তাদের দেখবো বা ছবি তুলব, এমন সুযোগ আসছে না। বাঁদর না কি হনুমানের হুপ্‌ হাপ্‌ শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ যেন বন একেবারেই নিস্তব্ধ। কলকাকলি, হুপ্‌ হাপ্‌ সব চুপ। মাহুতের উদ্দেশ্যে ‘শোলে’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপটাই আউড়ে বসলাম – “ইত্‌না সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই?” সে শুধু মুখে আঙুল দিয়ে আমাদের চুপ করতে বললো। হাতি কিন্তু মাহুতের নির্দেশে আমাদের নিয়ে এগিয়ে এক জায়গায় থেমে গেলো। দেখলাম এক সাদা বিদূৎ ঘাসের জঙ্গলের একদিক থেকে বেরিয়ে অন্য দিকে ঢুকে গেলো – গায়ে কালো ডোরা। একবার শুধু আমাদের দিকে দৃষ্টি ফেরালো – ব্যাস্‌! ওই পর্যন্তই। তার চলার গতির একটুও তারতম্য হলো না। যেন আমাদের তুচ্ছজ্ঞান করেই নিজের পথে চলে গেলেন ব্যাঘ্রমহাশয়।

দু’ঘন্টার জঙ্গল সফর আপাততঃ শেষ। ফিরে চলেছি লজের দিকে। ফেরার পথে দেখে নিলাম – এক জলাশয়ের ধারে শায়িত পাথরের এক বিশাল বিষ্ণুমূর্তি। তাঁর পাশে মনে হয় অন্য দেবতাও রয়েছেন, কিন্তু ঢেকে গেছেন গাছপালায়। সামনেই জলাধার। বিষ্ণুমূর্তির পায়ের তলা দিয়ে জল নিঃসৃত হয়ে এই জলাধারে মিশছে। এরই নাম চরণগঙ্গা।

এবার হাতি থেকে নেমে, ওমনিবাসে করে পৌঁছে গেলাম আমাদের কটেজ-লজে। প্রাতঃরাশ প্রস্তুত। আমরা ডাইনিং হলে সকলে উপস্থিত হলাম। আলুর পরোটা, সঙ্গে তরকারী, টক দই, চাটনী। যার যেমন পছন্দ নিয়ে নিলাম। শুনলাম এখানে রোজ পাঁউরুটি, মাখন, জ্যাম, ডিম দেওয়া সম্ভব নয়। বাজার অনেক দূরে। ওরা বাজারে সপ্তাহে একদিন গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র নিয়ে আসে। তাই ওদের যেমন জিনিষ থাকবে, তাই দিয়েই ওরা আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমার তো খুব মজা – রোজ একঘেয়ে পাঁউরুটি খাওয়ার চেয়ে এইসব খাবারই আমার বেশী পছন্দ।

বেলায় ভাত, ডাল, তরকারী, ডিমের ঝোল ও টক দই দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে যে যার ঘরে ফিরে এলাম। দুপুর ৩টেয় আবার তৈরী হয়ে সবাই বেরিয়ে এলাম – আবার চললাম অরণ্য সফরে। সেই একই ভাবে হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করে এগিয়ে চলেছি। মনে ইচ্ছে যদি আবারও একবার বাঘের দেখা পাই – ছবি তুলতে পারি। মাঝে মাঝেই দেখছি বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ। কিন্তু যার জন্যে এসেছি সে কোথায়? বনের রাজা – সেই ডোরাকাটা?

এবার মাথা বাঁচাতে সকলে টুপি পরে এসেছি। সঙ্গে সকলেরই ক্যামেরা ও বাইনোকুলার। কিছুদূর গিয়ে মাহুত দেখালো – এই দেখুন ‘পাগমার্ক’ – বাঘের পদচিহ্ন। একটু আগে এখান দিয়ে নিশ্চয়ই কোনোও বাঘ গিয়েছে। মাহুতের নির্দেশে হাতি সেই পাগমার্ক অনুসরণ করলো। আমাদের মুখে কোনোও কথা নেই। সবাই চুপ।

এবার দেখা গেলো তাকে – বনের রাজাকে। সে তখন এক গাছের তলায় বিশ্রামরত – আধঘুমন্ত। আমাদের দেখে সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করলো। মাহুতের নির্দেশে হাতিও তার পিছু নিলো। বাঘ যায়, হাতি যায়। বাঘ গতি বাড়ালে হাতিও গতি বাড়ায়। আমরা শুধু চুপটি করে হাতির পিঠে নিজেদের ভারসাম্য বজায় রেখে বসে দেখছি আর দেখছি। কল্যাণের সাদা টুপি পড়ে গেলো। মজা করে আমি বললাম, যাক, ভালোই হলো – এবার থেকে রোদ বাঁচাতে বাঘই না হয় ওই টুপি পরে ঘুরে বেড়াবে।

অবশেষে বাঘ হার মানলো হাতির কাছে – না কি আমাদের আগ্রহের কাছে – কে জানে! রাজকীয় ভঙ্গিমায় ‘পোজ’ দিয়ে সে বসে পড়লো খোলামেলা জায়গায় ছোট এক গাছের সামনে। আমাদের ছবি তোলার সুবিধের জন্যে।

ফিরে চলেছি আমাদের কটেজ-লজে। দেখা হলো অনেকের সঙ্গেই। শুধু দেখা হলো না, এই বনের আর এক অধিবাসী ভাল্লুকের সঙ্গে।

আমাদের বান্ধবগড় ভ্রমণ সার্থক। এভাবে এতো কাছ থেকে দেখা বা তাকে ধাওয়া করা এমন ক’জনের ভাগ্যে ঘটে?

পরদিন রবিবার আমাদের সকাল Free। তাড়াতাড়ি দ্বিপ্রাহরিক আহারের পরে এগিয়ে যাবো কান্‌হার পথে। লজের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালাম। পলাশগাছের তলায় ছবি তুললাম। এখানে ওখানে গাছের ওপর দেখলাম, বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে কিছু বাঁদরের সংসার। তারা নিজেদের মধ্যে ‘বাঁদরামি’-তেই ব্যস্ত – অন্যদিকে নজর নেই।

সে সময়ে প্রতি রবিবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা, একঘন্টা DD-1 টি.ভি. চ্যানেলে বি. আর. চোপরার মহাভারত সম্প্রচারিত হতো। আমরা প্রত্যেকেই সেই অনুষ্ঠান দেখতাম। কিন্তু বনের নিয়ম মেনেই এই লজে কোনোও টি.ভি. নেই। ম্যানেজারকে বলাতে তিনি বললেন যে, এখানে একমাত্র Community Cenre-এর Hall-এই টি.ভি. রয়েছে। আর কোথাও নেই। তিনি আমাদের সকলকে নিয়ে গেলেন সেখানে।

সেখানে গিয়ে দেখলাম, আশে পাশের সব গ্রামের মানুষই জড় হয়েছে মহাভারত দেখতে। তারা আমাদের খাতির করে চেয়ারের ব্যবস্থা করতে চাইলো। আমরা আপত্তি জানিয়ে এই সরল, সাদাসিধে মানুষদের সঙ্গে মেঝেতে বসেই মহাভারত উপভোগ করলাম। আমরা যে তাদের সঙ্গে একাত্ম হলাম, তা দেখে তারা খুব খুশী হলো। তাদের খুশীতে আমাদেরও আনন্দ হলো। এমন অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম আর এই শেষ। এতো জায়গা বেড়াবার সূত্রে আমার মনে হয়েছে – এই সব সরল, সাদাসিধে মানুষগুলোই ভারতবর্ষের প্রকৃত মুখ। আমরাই শুধু নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে তাদের কাছ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখি।

লজে ফিরে দুপুরের আহারের পর আবার সেই ‘অলউইন নিশান’-এ করেই আমরা রওনা হলাম কান্‌হার পথে – সঙ্গে চললেন আমাদের সেই ম্যানেজার।

আমার এই প্রথম অরণ্য ভ্রমণে আমার এক আশ্চর্য উপলব্ধি হলো। এই যে সব বন্য জন্তু – মাংসাশী ও তৃণ তথা উদ্ভিদভোজী – এরা তো বেশ সকলে একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে। অরণ্যে এদের গতিবিধি তো সর্বত্রই অবাধ। কোনোও সীমারেখা টানা নেই। শুধুমাত্র ক্ষুধার কারণেই মাংসাশী প্রাণী জীবহত্যা করে বা উদ্ভিদভোজী প্রাণী গাছপালা ধংস করতে বাধ্য হয়, অন্যথায় নয়। তবে কি এরা জানে বা বোঝে যে, কোনোও কারণে যদি এই অরণ্য ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে?

— প্রথম পর্ব সমাপ্ত —

 

 

গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. পড়লাম। বেশ সুন্দর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তথ্য সমৃদ্ধ।

  2. এটা একদম অন্য পরিবেশ।details are there which brings life into your description s.Well written.💐💐👌👌

  3. মনে পড়ছে আমার বন্ধু শংকর “Call of the wild” trip সম্পর্কে আগাম guarantee দিয়ে জানিয়েছিল যে আমাদের খুব ভালো লাগবে এবং worth paying. Trip টা শেষ করে বুঝতে পারলাম যে শংকর একদম সঠিক কথা বলেছিল। বেড়িয়ে কলকাতায় ফিরে বাড়ির সবাইকে আমাদের ভালো লাগার কথা বলাতে পরিবারের অন‍্যান‍্যরাও এই trip টা করেছিল। এতবছর পর গোপার লেখাটা পড়ে খুটিনাটি সব চোখের সামনে হাজির হয়ে গেল। লেখা গুলো পড়ে ভুলে যাওয়া ঘটনাগুলো আবার মনে করিয়ে দেবার জন্য গোপাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। 💐💐💐💐

Leave a Reply to Shubhajit Sarkar Pom Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!