Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৩
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৩

গোপা মিত্র

লক্ষ্ণৌ হয়ে নৈনিতাল, রানীক্ষেত, কৌশানী

 

।। প্রথম পর্ব ।।

এবার ফিরে চলেছি, ডিজিট্যাল ও রঙ্গীন ছবির যুগ থেকে বক্স ক্যামেরা ও সাদা-কালো ছবির যুগে। সেই যেন কতো যুগ আগে ১৯৭২ সালে গিয়েছিলাম লক্ষ্ণৌ, নৈনিতাল, রানীক্ষেত, কৌশানী। লক্ষ্ণৌ ছিলো তখন নৈনিতালের প্রবেশদ্বার – তাই যাওয়া। অবশ্য গেছিই যখন, তখন সে জায়গাটাও একবার দেখেই আসবো। তবে দু-তিনদিনে কি সমগ্র লক্ষ্ণৌ দেখা যায় – ওই পাখীর চোখে দেখা আর কি। সিমলা মুসৌরী আগেই দেখা। তাই স্থির হলো এবার আমরা নৈনিতাল, রানীক্ষেত যাবো – সঙ্গে কৌশানী। এই শেষ নামটি তখন সদ্য জেনেছিলাম।

এবার আমাদের সঙ্গী অসিতদা (আগে যাঁর সঙ্গে মানালী গেছিলাম) ও তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা। লক্ষ্ণৌতে ঝর্ণার দাদারা থাকেন। স্থির হলো আমরা সেখানে দু’দিন থেকে নৈনিতাল রওনা হবো।

সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো – ট্রেনের টিকিট, নৈনিতাল, রানীক্ষেতের হোটেল বুকিং – সব। পয়লা বৈশাখ তেরোশো ঊনআশি সন (ইংরাজী ১৪ই এপ্রিল, ১৯৭২) শুক্রবার, আমরা বেরিয়ে পড়লাম হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে অবশ্য সকলেই অসন্তুষ্ট – আমরা পয়লা বৈশাখ বেরোচ্ছি বলে। পয়লায় না কি “যাত্রা নাস্তি” – অশুভ দিন। আমাদের এ সব জানা ছিলো না – সব ব্যবস্থা সারা, তাই কিছু করার নেই।

এবার কল্যাণের পোষাকের কথায় আসা যাক। পরনে সাদা আদ্দির পাঞ্জাবী আর পাজামা। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম, এমন ক্যাজুয়াল ড্রেসে বেরোবার জন্যে। কিন্তু ওর বক্তব্য পয়লা বৈশাখ বাঙালীর ঐতিহ্য – এই সব।

যাত্রার আগে তখন ট্রেনের দরজায় রিজার্ভেশন চার্ট টাঙিয়ে দিতো। ভিড়ের মধ্যে সেই চার্টে নাম দেখে আমরা তো কামরায় এসে সবাই গুছিয়ে বসলাম। ট্রেনও ছেড়ে দিলো। এইবার এলো সেই ধাক্কা – কল্যাণের পকেট থেকে পার্সটি কেউ তুলে নিয়েছে। আলগা পাঞ্জাবী পরে ‘বাবু’ সাজার শাস্তি। এইবার বুঝলো এই সাজে কি ভুলই করেছে সে। অবশ্য বেশী টাকা ছিলো না, সামান্য পথ খরচাটুকুই যা ছিলো। আমার মনে অবশ্য একটা কাঁটা বিঁধেই রইলো – তবে কি পয়লা তারিখ বেরোবার জন্যেই এমন হলো?

গোমতী নদীর তীরে ইতিহাসের নবাবী শহর লক্ষ্ণৌ বর্তমানে উত্তর প্রদেশের রাজধানী। নদীর উভয় তীরেই শহরের বিস্তার – একাধিক সেতু দিয়ে সংযুক্ত। এক ঐতিহাসিক শহরের আকাশ-বাতাস-নদী-রাজপথে লেগে থাকা শতাব্দী প্রাচীন রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধকে উপলব্ধি করতে হলে লক্ষ্ণৌ আসতেই হবে।

এ শহর একদিকে যেমন তার তিনশো বছরের পুরনো নবাবী স্মৃতিকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায় তার অলিতে-গলিতে, অলিন্দ-আলসেতে – তেমনই আর এক দিকে তার রাজপথ দখল করে নিতে চায় পশ্চিমী আধুনিকতা।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের এক প্রাচীন বাড়িতে – ঝর্ণার দাদাদের বাড়ি। অলি-গলি পথে আমরা সেই বাড়ির সামনে এসে পৌঁছে দেখলাম যে, তার বিস্তার বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে। উচ্চতায় অবশ্য বেশী নয়। তবে দেখলাম বাড়ি একটা হলেও প্রবেশদ্বার অনেকগুলি। সম্ভবতঃ এখানের বসবাসকারী বিভিন্ন পরিবার যে যার নিজের মতো প্রবেশপথের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সরু খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় দুটো কড়ি-বরগার ছাদযুক্ত ঘর – সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দাদাদের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় আমরা আপ্লুত হয়ে গেলাম।

নবাবী স্থাপত্যের ছড়াছড়ি লক্ষ্ণৌতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবাব আসফ-উদ-দ্দৌলা নির্মিত ‘বড়া ইমামবাড়া’ আর তার থামবিহীন ১৬৪ ফুট দীর্ঘ ও ৫২ ফুট প্রশস্ত হলঘরটি। গম্বুজ ও খিলানবিশিষ্ট এই স্থাপত্যটি ইসলাম ধর্মের তিন বিশিষ্ট ইমামের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই গোলকধাঁধা – প্রসিদ্ধ ভুলভুলাইয়া নামে। এখানে এমনই আঁকাবাঁকা পথ যে, গাইড ছাড়া পথ খুঁজে পাওয়া যায় না – বেরিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব। আবার দেশলাই জ্বালালে বা ফিসফিস করে কথা বললে শোনা যায় এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। এই ভুলভুলাইয়া আমাকে মুগ্ধ করেছে। এমন আশ্চর্য নির্মানশৈলী আমি কোথাও দেখিনি। এই চত্বরের বাঁয়ে রয়েছে ‘আসফি মসজিদ’ ও ডানদিকে অতল জলের কুয়ো, ‘বাওসি জলাশয়’।

এখান থেকে ‘ছোটা ইমামবাড়া’-র দিকে যেতে পড়ে কারুকার্যময় ৬০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ‘রুমি দরওয়াজা’ – তুর্কী স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত। এরও নির্মাতা নবাব আসফ-উদ-দ্দৌলা। এটি প্রাচীন লক্ষ্ণৌয়ের প্রবেশ তোরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর কাছেই রয়েছে অন্য এক নবাব নির্মিত ২২১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ‘ক্লক-টাওয়ার’।

মহম্মদ আলি শাহ্‌ নির্মিত ছোটা ইমামবাড়া তাঁর নিজের ও তাঁর মায়ের স্মৃতিসৌধ। সবুজ ও সাদা বর্ডার দেওয়া এর বিশাল প্রার্থনা গৃহটি অজস্র রঙ্গীন ঝাড়বাতি ও স্ফটিক কাঁচের আলোকদণ্ডে সজ্জিত। এর দেওয়াল জুড়ে রয়েছে কোরাণের পবিত্র উদ্ধৃতি। এর থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে ‘জামা মসজিদ’।

গোমতীর তীরে একসময়ে ইংরেজদের বাসস্থান ‘দি রেসিডেন্সি’। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে স্বল্প সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য এই ভবনে আশ্রয় নিয়ে সিপাহীদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিলো। সিপাহীদের গোলাগুলিতে ধ্বংস এই ভবন। আমরা দেখলাম ধ্বংসাবশেষ ঘিরে বাগান আর সবুজ ময়দানে এই অঞ্চলটি সজ্জিত।

পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের নবাবী স্থাপত্য যতটা সম্ভব আমাদের দেখা হয়ে গেলো। রাতে ঝর্ণার দাদারা আমাদের নিয়ে গেলো লক্ষ্ণৌয়ের বিখ্যাত ‘গালৌতি কাবাব’ আর ‘কুলফি ফালুদা’ খাওয়াতে। যারা এর স্বাদ না পেয়েছে তারা যে কি মিস্‌ করেছে, আমি বলতে পারবো না।

পরদিন সকালে আমরা বেরোলাম আধুনিক লক্ষ্ণৌয়ের দিকে। সেখানে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে বেড়িয়ে, এসে পৌঁছলাম প্রাচীন লক্ষ্ণৌয়ের বিখ্যাত চকবাজারে। বিশাল বাজার – অ্যান্টিক দ্রব্যের সঙ্গে আধুনিক দ্রব্যের সমাহার। পুরাতনের সঙ্গে বর্তমানের সহাবস্থান। লক্ষ্ণৌয়ের বিখ্যাত চিকনের আর জরিকাজের শাড়ি, দোপাট্টা, সালোয়ার-কামীজ – এছাড়াও নাগরা জুতো, প্রসিদ্ধ নবাবী আতর, খস পানমশলা ইত্যাদি সবেতেই রয়েছে নবাবী আমলের ঘ্রাণ। আর রয়েছে একাধিক মোগলাই খানার দোকান।

দুদিনে লক্ষ্ণৌ সফর শেষ। আমি ইতিহাসপ্রেমী নই। প্রকৃতিপ্রেমী। তাই লক্ষ্ণৌ শহরের অনেক স্মৃতিই হয়তঃ আজ হারিয়ে গেছে। মনে রয়ে গেহে শুধু ভুলভুলাইয়া। কি অপূর্ব তার নির্মাণশৈলী। ছোট্ট ছোট্ট ঘর – এক ঘর থেকে অন্য ঘরে সহজেই যাওয়া যায়। কিন্তু কেউ যদি মাঝপথে বেরিয়ে আসতে চায়, পথ না জানলে সে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারবে না। কারণ, প্রবেশ বা বাহিরপথ মাত্র একটাই।

সেই রাতেই আমাদের যাত্রা নৈনিতালের পথে – মিটারগেজ ট্রেনে। পরদিন সকালে কাঠগোদামে নেমে সেখান থেকে বাসে করে পাহাড়কে কখনোও ডাইনে কখনোও বাঁয়ে রেখে, কখনোও বা কোনোও পাহাড়ি নদীকে সঙ্গী করে পৌঁছে গেলাম চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এক বিশাল হ্রদের পাশে – নৈনিতাল।

উত্তরাখণ্ডের (তখনকার উত্তরপ্রদেশ) কুমায়ূন হিমালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় শৈলশহর নৈনিতালের অবস্থান ৬৮৩৭ ফুট উচ্চতায়। নৈনিতালের প্রাণভোমরা নৈনি হ্রদের পরিধি প্রায় দুই মাইল। ‘তাল’ অর্থাৎ হ্রদ বা সরোবর। হ্রদকে ঘিরেই গোল করে গড়ে উঠেছে পাহাড় অরণ্যের মিশেলে এই শৈলশহর। ভারতের হ্রদনগরী বলা হয় নৈনিতালকে। কথিত আছে, এখানে সতীর বাম নয়ন পড়েছিলো। তাই এই হ্রদের নাম ‘নৈনি’ বা নয়ন। হ্রদের নামেই এই শহরের নাম।

হ্রদের পাস দিয়ে চলে গেছে বাঁধানো পথ – ম্যাল রোড। পথিপার্শ্বে চিনার, পপ্‌লার, দেবদারু বৃক্ষরাজি। ম্যাল রোডের সূচনা তাল্লিতালে, সমাপ্তি মাল্লিতালে। তারপরেই রয়েছে এক বাঁধানো চত্বর – সেখানে বসার ব্যবস্থা। পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে জনবসতি, হোটেল ইত্যাদি।

বাস-টার্মিনাস তাল্লিতালে। কিন্তু আমাদের ‘ইণ্ডিয়া হোটেল’ মাল্লিতালে। মালপত্র নিয়ে কোনোওক্রমে আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। দোতলায় হ্রদের মুখোমুখি চমৎকার ঘর – সঙ্গে প্রশস্ত এক বারান্দা। হ্রদের অপরদিকের অরণ্যাবৃত পাহাড়, সরু রাস্তাটা তাকে যেন সাপের মতো জড়িয়ে রেখেছে, হ্রদের শেষ প্রান্তে নয়নাদেবীর মন্দির, সামনের বৃক্ষ ছাওয়া পথ আর রংবেরঙের নৌকা ভাসা নৈনিতাল – এই সব কিছুর এক অপূর্ব কোলাজ ধরা পড়ে আমাদের সেই চমৎকার বারান্দা থেকে।

হাল্কা শীতের ছোঁয়া মেখে সেই বিকেলেই আমরা হেঁটে এলাম মাল্লিতাল থেকে তাল্লিতাল। এমনই বেশ কয়েকবার করলাম। ইচ্ছামতো বিশ্রাম মাল্লিতালের পাশের সেই চত্বরে। কি যে ভালো লাগলো – পর্যটকদের আর গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়হীন এই ম্যাল রোড দিয়ে চারিপাশের প্রকৃতির সঙ্গে হেঁটে যেতে, যে হাঁটেনি তাকে বোঝাবো কেমন করে?

পরদিন শীতের কবোষ্ণ রোদের পরশ নিয়ে আমরা বার হলাম সবুজ-নীল জলের নৈনি হ্রদে বোটিং করতে। হ্রদের জলে ভেসে চলা কোনোও এক ঝরা পাতা সঙ্গী করে নৌকা বেয়ে ভেসে বেড়াবার আনন্দে আমরা সারা সকালটাই প্রায় কাটিয়ে দিলাম।

হোটেলে এসেই সেই আনন্দ উধাও। ঝর্ণার বেশ জ্বর – মুখ-চোখও লালচে হয়ে উঠেছে। অসিতদা আর ঝুঁকি নিলেন না। ঝর্ণাকে নিয়ে ফিরে গেলেন লক্ষ্ণৌতে। সেই দাদাদের বাড়ি – ঝর্ণা সুস্থ হলে সেখান থেকে ফিরে যাবেন কলকাতা। আমার মনে আবার সংশয়। এটাও কি “অশুভ পয়লা”-র দুর্গ্রহ? কি জানি!

 

(শেষাংশ পরবর্তী পর্বে)

লেখিকা পরিচিতি
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. এখনও সবটা ত লেখা হয়নি । শেষ হলে মিলিয়ে দেখো তোমার আর আমার দেখা মিললো কিনা! পড়ার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ।

    1. দারুণ বিবরন। পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম। আমরা
      গেছি নৈনিতাল তোমার যাওয়ার পঁচিশ বছর পরে।

  2. পঁচিশ বছরের পরিবর্তন তাহলে তোরা বুঝতে পারবি ।

  3. খুব ভালো হয়েছে। তবে প্রথম ছবিটির তুলনা নেই। সত‍্যজিত রায়ের ফ্রেমে দেখলুম যেন।

    1. গোমতী নদীর ধারের এক পাঁচিল এ বসা –কত যুগ আগে যেন —

    2. Excellently composed…we could travel alongwith you which is the true texture of a Bhromonkaahini….

  4. খুব ভালো লেখা হয়েছে। একদম ভুলে যাওয়া ঘটনাগুলো আবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।।💐💐💐

Leave a Reply to গোপা মিত্র Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!