Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১১
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১১

গোপা মিত্র

যোধপুর থেকে জয়সলমীর

।। প্রথম পর্ব ।।

পাহাড় পর্বত পার হয়ে এবার এসে পৌঁছেছি মরুভূমিতে, মরু শহর জয়সলমীরে। অবশ্য বেশীদিন এখানে থাকবো না। আবারও ফিরে যাবো পাহাড়ে – সেখানেই আমার অক্সিজেন, না হলে যে দম বন্ধ হয়ে যাবে।

সোনার কেল্লা। জয়সলমীরে ট্রেন থেকে নেমেই দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এলো প্রভাত সূর্যের সোনালী কিরণে ঝলমলে বেলে পাথরে তৈরী ‘ত্রিকূট দূর্গ’ – আমাদের কাছে ‘সোনার কেল্লা’। এর অনেক বছর আগেই ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমা আমার দেখা হয়ে গেছে। এই সিনেমায় ঝলমলে ত্রিকূট দূর্গ দেখে আমি বিস্মিত – এমন সোনালী কেল্লা হয় না কি? এমনিতে আমি অবশ্য এসব কেল্লা দেখায় খুব আগ্রহী নই। আমার মনে হয় সব কেল্লাই এক রকম – অনেকগুলি কামরা, চত্বর, আম-দরবার এইসব নিয়ে। কিন্তু এ যেন অন্যরকম – এর রং, স্থাপত্য, ভাস্কর্য সবই এতো দৃষ্টিনন্দন – চোখ ফেরানো যায় না।

১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসের একেবারে শেষে যখন আমার দিল্লীনিবাসী বোন আনুর কাছে যাওয়া স্থির হলো, তখনই আনুর সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা করে ফেললাম যে, আমরা এবার যোধপুর হয়ে জয়সলমীর যাবো – সোনার কেল্লা দর্শনে। এর আগে তো আমার মরুভূমিও দেখা হয়নি। এবার মরুভূমিতেও একবার যাবো, আর এক-কুঁজ উটের পিঠেও চড়বো – যেমন দেখানো হয়েছিলো সোনার কেল্লা সিনেমায়।

দিল্লী থেকে আনু ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেললো। একরাত্রি ট্রেনে যোধপুর – সেখান থেকে পরের রাতে ছোট লাইনের ট্রেনে ভোরবেলা জয়সলমীর। ফেরাও ওই একই ভাবে। স্থির হলো, যাওয়ার সময়ে যোধপুরে আমরা যোধপুর দূর্গ দেখবো। ফেরার পথে আমরা যোধপুরে ‘উমেদ ভবন’ প্যালেস দেখবো।

সেইমতো আমরা ট্রেনের থ্রি-টায়ার কামরায় দিল্লী থেকে যোধপুরের পথে যাত্রা করলাম। আমরা – আমি, কল্যাণ, সোনাই, আনু, সুনীত, জিঙ্কু আর পার্বতী – জিঙ্কুকে দেখাশোনা করে যে মেয়েটি – অর্থাৎ মোট সাতজন। ভোরবেলা পৌঁছে গেলাম মরু শহরের প্রবেশদ্বার যোধপুর। এসে উঠলাম স্টেশনের কাছেই দোতলা এক ধর্মশালায়। তৈরী হয়ে দোকান থেকে প্রাতঃরাশের পর আমরা রওনা হলাম যোধপুর ফোর্ট দেখতে।

রাঠোর বীর রাও যোধা নির্মিত দীর্ঘ প্রাকারবেষ্টিত যোধপুর দূর্গ বা মেহ্‌রানগড়, ভারতের বৃহত্তম দূর্গগুলির অন্যতম। রাও যোধার নামেই শহরের ও পঞ্চদশ শতকে নির্মিত এই দূর্গের নামকরণ। শহর থেকে চড়াই পথে ৪১০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ওপর অবস্থিত যোধপুর দূর্গ বা মেহ্‌রাঙ্গড়ে পৌঁছনো গেলো। বিশাল এই দুর্ভেদ্য দূর্গে রয়েছে ৭টি বিজয় দরওয়াজা বা পোল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা বা মহারাজা এই পোলগুলি নির্মান করেছিলেন তাঁদের যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে। একটি পোলে আবার রয়েছে সারি সারি লৌহকীলক, প্রতিপক্ষের যুদ্ধহস্তীকে প্রতিহত করবার জন্যে। জয়পুর বিজয়ের পর ‘জয়পোল’ বা ‘বিজয়-দরওয়াজা’-র প্রতিষ্ঠাতা মানসিংহ। দরজার পাশে ও দেওয়ালের চারিদিকে রয়েছে কামানের গোলার চিহ্ন। রয়েছে একটা কামানও। মুঘল রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধজয়ের পর মহারাজা অজিত সিংহ নির্মাণ করেছিলেন ‘ফতেপোল’। লোহাপোলের পরেই রয়েছে যে সমস্ত মহারানী ‘সতী’ হয়েছিলেন তাঁদের হস্তচিহ্ন বা সতীচিহ্ন।

প্রবেশ তোরণ পার হয়েই রয়েছে এক স্মৃতিস্তম্ভ – রাজারাম মেঘওয়ালের। যোধপুর রাজ রাও যোধা তাঁর রাজ্য সুরক্ষিত রাখতে যখন মান্ডোর থেকে রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত করে এই দূর্গ নির্মাণ মনস্থ করেন, তখন এই সৈনিক রাজারাম মেঘওয়াল স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে কোনোওদিনও দূর্গে জলসঙ্কট না হয়। পরিবর্তে তাঁর পরিবারকে রক্ষা ও দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মহারাজ।

প্রবেশ তোরণ পার হলেই, বিশাল প্রাঙ্গন রাজকীয় অভ্যর্থনা জানায় ঐতিহ্যশালী রাজস্থানী লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে। চারিদিকে তখন প্রাচীন রাজস্থানের ঘ্রাণ। প্রাঙ্গনের চতুর্দিকে কারুকার্যময় সূক্ষ্ম জালিকাজ, ঝরোখা ও স্তম্ভ সমৃদ্ধ দুই বা তিনতলা বিশিষ্ট মহলগুলি তখন আমাদের পৌঁছে দিয়েছে রাজস্থানের ঐতিহ্যময় অতীতে।

মেহ্‌রানগড় হলুদ ও লালচে গোলাপী পাথরে নির্মিত মুঘল ও রাজস্থানী স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। একাধিক তল বিশিষ্ট মহলগুলির অনেকগুলি কক্ষই অবশ্য ব্যবহৃত হয়, প্রদর্শনী কক্ষ হিসাবে। সেগুলি সজ্জিত সে সময়কার রাজা-মহারাজাদের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে।

দূর্গের সবচেয়ে সুন্দর মহলগুলির অন্যতম শিশমহল, ফুলমহল ও তাকতমহল। রাজা অজিত সিংহ নির্মিত শিশমহলে সিলিং, দেওয়াল ও স্তম্ভগুলি সজ্জিত প্রায় হাজারটি দর্পণ দ্বারা। এর একটি দর্পণে আলো পড়লেই, সমস্ত মহল যেন ঝলমল করে ওঠে – ধাঁধা লেগে যায় চোখে। তারই পুত্র রাজা অভয় সিংহ নির্মিত ফুলমহলের সিলিং, দেওয়াল চারিদিক সজ্জিত কারুকার্যময় অসংখ্য ফুলে। ফুলগুলি অবশ্য সাধারণ নয় – স্বর্ণ, রৌপ্য ও বিভিন্ন রঙের মূল্যবান পাথরে খচিত ফুলগুলির দিক থেকে চোখ ফেরানোই মুশকিল। মহলের সজ্জা আরোও বর্ধিত করে, জানলায় রঙ্গীন কাঁচের ব্যবহার। তাকত সিংহ নির্মিত তাকত বিলাস মহল সজ্জিত সোনা এবং নীল-সাদা পাথর ও দর্পণ দ্বারা। ছাদে ঝুলছে কতকগুলি রং-বেরঙের উজ্জ্বল রঙীন বল – ঠিক যেন ক্রিসমাস বল। শোনা যায় এগুলি ব্রিটিশরা রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন।

শৃঙ্গারচকে রয়েছে দুইটি প্রদর্শনী কক্ষ। এতে রয়েছে হাতির হাওদা ও রাজকীয় সিংহাসন। দুই কক্ষ বিশিষ্ট হাতির হাওদার নির্মিতি কাঠের ওপর সোনা, রূপা ও বিভিন্ন মূল্যবান পাথর দ্বারা। হাওদার একটি কক্ষ বড়, পা ছড়াবার জায়গা বেশী – এতে বসতেন রাজা। ওপর কক্ষ ছোট – এতে বসতেন রাজার দেহরক্ষী।

তিনতলা দৌলতখানা ব্যবহৃত হতো খাজানা রক্ষার জন্য। নিচে ছিলো রাজার দরবারকক্ষ। এর অদ্ভুত স্থাপত্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখন অবশ্য দৌলতখানার কক্ষগুলি রূপান্তরিত হয়েছে প্রদর্শনী কক্ষে। এই কক্ষগুলির একটিতে রয়েছে রাজকীয় পালকী। এদের মধ্যে ওপরে ডিম্বাকৃতি বিখ্যাত মাহদল পালকীও রয়েছে, যা রাজা যুদ্ধজয়ে পেয়েছিলেন, গুজরাটের গভর্ণরের কাছ থেকে। এই পালকীগুলি রাজপরিবারের মহিলারা বা অভিজাত রাজপুরুষরা ব্যবহার করতেন। অস্ত্রকক্ষে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে রাজাদের ব্যবহৃত তরবারিগুলি – স্বর্ণ, রৌপ্য ও মনি-মুক্তাখচিত খাপ ও হাতলবিশিষ্ট। আর রয়েছে বন্দুকের সম্ভার – সেগুলিও সোনা-রূপা-মনি-মানিক্যে কারুকার্যময়।

বস্ত্র ও পরিচ্ছদকক্ষে রয়েছে সেকালের রাজারানীদের পোষাক পরিচ্ছদ ও আভূষণ। আর রয়েছে একাধিক খোপবিশিষ্ট বিচিত্র এক সিন্দুক। এর মধ্যে রাজপুত রমনীরা তাঁদের অলংকার রাখতেন। একটি কক্ষে রয়েছে মুঘল ও রাজস্থানী চিত্রের মিনিয়েচার পেন্টিং। রাজস্থানী চিত্রকলা যে কতো সমৃদ্ধ ছিলো, এর থেকেই বোঝা যায়। পাগড়ী কক্ষে রয়েছে রংবেরঙের হরেক কিসিমের পাগড়ী, যাদের বন্ধন ও পাক বিভিন্ন রকমের। রাজস্থানীরা বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ বন্ধনের পাগড়ী ধারন করেন। আবার জাতিভেদেও ওদের পাগড়ীর ধরণ বিভিন্ন হয়। মোটামুটি ওদের পাগড়ীর ধারণ দেখেই অনেক কিছু বুঝে নেওয়া যায়।

যোধারাওজীর ইষ্টদেবী চামুণ্ডার এক মন্দির রয়েছে দূর্গে। দশেরায় এখানে বিরাট উৎসব হয়।

দূর্গের জানলা থেকে নিচের যোধপুর শহরটা বেশ ভালোই দেখা যায়। নীল বাড়িগুলির জন্যে একে “City of Blue”-ও বলা হয়।

ফেরার পথে দেখলাম, এখানে আরোও কয়েকটি কামানও রাখা রয়েছে।

আমাদের যোধপুর ভ্রমণ আপাততঃ শেষ। আজ রাতের ট্রেনেই আমাদের যাত্রা জয়সলমীর।

রাতের ছোট ট্রেনে আমরা চলেছি জয়সলমীর। মাঝরাতে, সম্ভবতঃ পোকরানের কাছে ঘুম ভেঙে গেলো প্রচণ্ড শীতে। কোন্‌ ফাঁকফোঁকর দিয়ে যে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে আমাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছে কে জানে! দেখলাম, সুনীতও উঠে বসেছে। আমরা সকলেই মোজা, গরম জামা – সব পরেই শুয়েছিলাম। এবার মাথায় কানঢাকা গরম টুপিগুলোও পরে নিলাম।

ভোরবেলা – সোনার কেল্লা! জয়সলমীর! একজন কুলী আমাদের জিনিসপত্র তুলে দিলো একটা গাড়িতে। তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বললো, যা দেবো তাতেই সে খুশী। টাকা পেয়ে সে বললো, “শুক্রিয়া”। এমন আশ্চর্য কুলী আমরা কোথাও দেখিনি, যে প্রাপ্য টাকা পেলে ধন্যবাদ জানায়।

এবার আমরা কোথাও Booking করে আসিনি। প্রথমেই চললাম রাজ্য পর্যটন নিগমের ‘মুমল’ ট্যুরিস্ট লজে। লজ প্রায় পর্যটকশূণ্য। আমরা সাতজন এবার একই ঘরে থাকবো মনে করে ডরমেটরী বেছে নিলাম। ইচ্ছে, আমাদের মেয়েরা একসঙ্গে খেলা করবে, পার্বতী তাদের দেখবে। আমরা বসে বসে আড্ডা দেবো।

ডরমেটরীটা বেশ বড়। অনেকগুলো বেড। কিন্তু সবই খালি। আমরা, আমাদের ক’জনের বেডভাড়া দিয়ে পুরো ডরমেটরীটাই দখল করে নিলাম। হলুদ পাথরের লজের নির্মিতি রাজস্থানী স্থাপত্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। নিচে দেখলাম গাছের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে এক দোলনা বা ঝুলা। আমাদের মেয়েরা সময় পেলেই সেখানে দুলতো। মাঝে মাঝে অবশ্য আমরাও এতে দুলেছি।

সেদিন আর সোনার কেল্লা গেলাম না। একটু বিশ্রাম নিয়ে তৈরী হয়ে আশেপাশে বেড়িয়ে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে চললাম, সোনার কেল্লা। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত রাজস্থানের এই দ্বিতীয় প্রাচীন দূর্গ – জয়সলমীরের কেল্লার প্রতিষ্ঠাতা ভাটি রাজপুত বংশের রাওয়াল জয়সল। তার নামেই দূর্গ ও নগরের নাম। প্রাচীন সিল্ক রুটের ওপর অবস্থান হেতু এই নগর এক বিশাল বানিজ্যনগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিলো। ভারতের একমাত্র ‘জীবন্ত দূর্গ’ (Living Fort) সোনার কেল্লা – কারণ, এখানে এখনোও ভাটি বংশের হিন্দু, রাজপুত বংশধররা বসবাস করে। ২০১৩ সালে এটি World Heritage Site-এর তকমা পেয়েছে।

ত্রিকূট পর্বতের ওপর এই বেলেপাথরের দূর্গ ১৫০০ ফুট দীর্ঘ ও ৭৫০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট, নগর থেকে ২৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সুউচ্চ গোলাকৃতি প্রাকারবেষ্টিত এই দূর্গের প্রাচীর ত্রিস্তর বিশিষ্ট, Interlocking System-এ তৈরী – দূর থেকে মনে হয় যেন অসংখ্য হলুদ ঢিবি। কিন্তু দূর্গে প্রবেশের পরই এর নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। দূর্গে প্রবেশ ও নির্গমনদ্বার একটি করে হলেও, অন্দরে রয়েছে চারটী দরজা বা পোল – অক্ষয়, সূরজ, গণেশ ও হাওয়াপোল। ওপরে রয়েছে ৯৯টি তোপমিনার ও ২টি কামান।

মুখ্য দরজা দিয়ে প্রবেশ করে মানিকচকে প্রধান বাজার। নানারকম রাজস্থানী দ্রব্যসামগ্রী – পোষাক-পরিচ্ছদ, গয়না, পুতুল, বেলেপাথরের নানা সামগ্রী ও বহুবর্ণ পাগড়ী ইত্যাদি – এইসবই বিক্রি হচ্ছে এখানকার দোকানগুলিতে। রয়েছে প্রচুর হোটেল ও রেস্তোরাঁ। আর রয়েছে ছড়ানো ছিটানো হলুদ পাথরের বাসগৃহ।

সূরজপোলের মাথায় খোদিত এক সূর্যমূর্তি – সূর্যের প্রথম কিরণ এখানেই এসে পড়ে। দূর্গের কেন্দ্রে ব্যস্ততম দশেরা চক বেষ্টিত রাজমহল, রানীমহল, রাজপুত্রমহল ও জৈনমন্দির দ্বারা। রাজমহল ও রানীমহল একেবারেই পাশাপাশি – বহু কক্ষবিশিষ্ট। সূক্ষ্ম জালিকাজ ও অসংখ্য ঝরোখা সমৃদ্ধ রাজমহলে রয়েছে একাধিক দরজা ও ছাদ। কিন্তু পাশের রানীমহল অসংখ্য কক্ষবিশিষ্ট হলেও শুধুমাত্র কারুকার্যময় সূক্ষ্ম জালিকাজ সমৃদ্ধ। রাজস্থানী রমনীদের আব্রুরক্ষার্থে এই ব্যবস্থা – জালিমধ্য দিয়ে শুধুমাত্র হাওয়া প্রবেশ করবে। রমনীদের দেখা যাবে না। কক্ষগুলি ব্যবহৃত হতো বৈঠকখানা, শোওয়ার ঘর, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর ইত্যাদিরূপে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একজায়গায় রয়েছে কারুকার্যময় এক পাথরের সিংহাসন। সম্ভবতঃ এটা ছিলো রাজার আম্‌-দরবার। রাজা সিংহাসনে বসলে প্রজারা নিচে বসতো।

সাতটি জৈন মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বিশাল পার্শ্বনাথজীর মন্দির। অপূর্ব স্থাপত্যের সঙ্গে এই মন্দিরগুলির ফুল-লতা-পাতায় কারুকার্যময় ভাস্কর্য ও নারীমূর্তিগুলি দেখবার মতো। মন্দিরের সিলিং ও স্তম্ভগুলিতেও খোদিত রয়েছে নানা শিল্পকীর্তি – অনেকটা মাউন্ট আবুর দিলওয়াড়া মন্দিরের মতো। মন্দিরের দেবতা পার্শ্বনাথজীর প্রস্তরমূর্তি ঝকমক করছে নানা অলঙ্কারে।

এছাড়াও লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দিরে রয়েছে লক্ষ্মী, বিষ্ণুমূর্তি। রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির – মন্দিরের চূড়া শিবমন্দিরের মতোই উঁচু হয়ে উঠেছে, কিন্তু দেবতা এখানে শিবলিঙ্গ নন্‌, পাথরের মহাদেবমূর্তি।

কেল্লার অন্দরের সবটাই তৈরী বেলেপাথরের। এর স্থাপত্য, ফুল-লতা-পাতা বা মূর্তির ভাস্কর্য সূক্ষ্ম কারুকার্যময় জালিকা, ঝরোখা, ব্যালকনি, ওপরের বহিঃর্মুখী ছত্রীগুলি, মাঝে মধ্যে ওপরে ওঠার সিঁড়ি – সব মিলিয়ে সোনার কেল্লা যেন এক সোনার চিত্রকোলাজ। এতো দৃষ্টিনন্দন, কোথাও কোনোও ছন্দপতন নেই।

সোনার কেল্লায় রক্ষিত কামান দেখার পর ছাদ থেকে দৃশ্যমান সমগ্র জয়সলমীর দেখে আমরা অপরিসর পথ ধরে ঝলমলে পোষাকের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে হলুদ বাসগৃহগুলি পার হয়ে বেরিয়ে এলাম জনপথে।

(শেষাংশ পরবর্তী পর্বে)

লেখিকা পরিচিতি
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. Wonderfully written. I have also visited in the year 2000. Also availed the night train and was tormented by the cold on the night train to Jaisalmer. Memories refreshed. Will wait for the next part.

  2. খুব ভালো লেখা। স্মৃতির ভান্ডার একটু ঝালিয়ে নিলাম।
    💐💐💐💐💐💐💐💐💐👌👌👌👌👌👌👌👌

  3. Just stupendous 💐💐👌👌!আর adjectivesমাথায় আসছে না।কি করে যে এক ই standard ধরে রেখেছো জানি না।all the best for the future

  4. এই কঠিন সময়ে একঘেয়ে জীবনে যদি একটু বৈচিত্র্য আনতে পারি ,তাতেই আমি খুশী ।

Leave a Reply to Ritwick Ray Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!