Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৮
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৮

গোপা মিত্র

কেদার বদ্রী

।। দ্বিতীয় পর্ব ।।

কেদার দর্শন সেরে, পরদিন আমরা চলেছি বদীনারায়ণের পথে। কদিন আগেই আসা সেই পুরনো চেনাজানা পথেই আবার ফিরে চলেছি। কিন্তু বহমান মন্দাকিনী, রং বদলানো প্রকৃতি আর সদা পরিবর্তনশীল হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, সত্যিই কি একই চেনাজানা পথেই চলেছি? সব কিছুর সঙ্গে কি পথেরও কোনোও পরিবর্তন হয় না? কি জানি!

এসে পৌঁছলাম রুদ্রপ্রয়াগে। এখান থেকে পথ বেঁকে গেছে বদ্রীনাথের দিকে। এই যাত্রাপথেই কর্ণপ্রয়াগে দুই নদীর সঙ্গমস্থল। পিন্ডারগঙ্গা ও অলকানন্দা নদীর এখানে ভয়াল রূপ – বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে সগর্জনে তারা ধেয়ে চলেছে।

এখান থেকে পার্বত্যপথে আমাদের সঙ্গী গর্জনরতা, ভয়ঙ্করী, নীলবর্ণা অনকানন্দা। কখনোও সে পাথর ফাটিয়ে, কখনোও বা হিমশৈল অগ্রাহ্য করে ধেয়ে চলেছে।

বদ্রীনাথের আগে রাতের জন্যে আমরা থামলাম যোশীমঠে। আজ এখানেই রাত্রিবাস। এখানেই আদি শঙ্করাচার্য সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। শীতে বদ্রীনাথ মন্দির বন্ধ হলে এখানেই স্থানীয় ‘নরসিং’ মন্দিরে বদ্রীনারায়ণের পুজো হয়।

যোশীমঠ থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বদ্রীনাথের পথ অত্যন্ত সরু এবং বিপদসঙ্কুল। সেই জন্যে সেই পথ একমুখী – অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্যে সেটা বদ্রীনাথ যাওয়ার রাস্তা থাকে আবার পরবর্তী কিছুক্ষণের জন্যে সেটাই হয়ে যায়, বদ্রীনাথ থেকে ফিরে আসার রাস্তা। এর জন্যে সময়ও নির্দিষ্ট থাকে। বিষ্ণুপ্রয়াগ থেকে একটি পথ বেঁকে চলে গেছে, ‘গোবিন্দঘাট’ হয়ে ‘হেমকুন্ড সাহেব’-এর দিকে। এরপর পড়ে ‘পান্ডুকেশ্বর’, যেখানে মহারাজ পান্ডু তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন। কথিত আছে, এই পথ ধরেই পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে রওনা হয়েছিলেন। পথ চলাকালীন বদ্রীনাথ মন্দিরটি আশ্চর্যভাবে একবার দেখা দিয়েই আবার গাছপালা পর্বতের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। পথের যেখান থেকে মন্দিরটিকে ওই একবারের জন্যে একঝলক দেখা যায়, সেই জায়গাটিকে বলা হয় ‘দেও-দেখ্‌নী’ বা ‘দেও-দেখানী’।

বদ্রীনাথের প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার আগে আমাদের বাস থেমে গেলো। বাসে কি গণ্ডগোল হয়েছে, আমাদের সকলের বোঝা বহনে অক্ষম। আমরা সব নেমে পড়লাম। আমাদের দলের ম্যানেজার সেখানেই আমাদের অপেক্ষা করতে বলে, সেই বাস নিয়ে বদ্রীনাথ চলে গেলেন; সম্ভব হলে সেই বাস সারিয়ে বা অন্য বাস নিয়ে আসবেন বলে। আমরা সকলে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হাঁটা শুরু করলাম। প্রত্যেকের সঙ্গেই গ্লুকোজের জল ছিলো। উচ্চতার কারণে ক্লান্তিতে, মাঝে মাঝেই সেই জল পান করছি আমরা – আবার চলছি। পা আর চলে না। এমন সময়ে দেখি, কয়েকজন আর্মি অফিসার সঙ্গে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা মিডিবাসে আসছেন। আমাদের অবস্থা দেখে তাঁরা থামলেন। তাঁরাও বদ্রীনাথ যাচ্ছে্ন – আমাদের পৌঁছে দিতে রাজী হলেন। আবার সেই সেনাবাহিনীর সাহায্য। আমরা সবাই সেই বাসে উঠে পড়লাম। দাঁড়িয়ে, বসে কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম বদ্রীনাথে।

বাস থেকে নেমে – এ কি দেখছি আমি? এক বিশাল এলাকা জুড়ে চারিদিকে বাজার, দোকান-পাট। লোকজনের চিৎকার চ্যাঁচামেচি – পর্বত, নদী, প্রকৃতি – এসব কোথায়? এ কোথায় এলাম আমি? এই কি বদ্রীনারায়ণ? পর্বতমালা জনগনকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে, অনেক দূরে সরে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়েছে। অলকানন্দা উধাও। আর প্রকৃতি? তাকে তো ধারেপাশে কোথাও খুঁজেই পাচ্ছি না। আমাকেই দেখছি, এদের সবাইকে খুঁজে বার করতে হবে।

সামনেই দেখি, একটা চায়ের দোকানে আমাদের ম্যানেজার বসে চা খাচ্ছেন। পাশে একটা গ্যারেজে আমাদের বাসের মেরামতি চলছে। আমাদের দেখে ম্যানেজার বিস্মিত হলেন। তারপর সব শুনে আমাদের চা অফার করলেন।

উত্তরাখণ্ডের (১৯৯৪ সালে উত্তরপ্রদেশ) বিষ্ণুতীর্থ বদ্রীনারায়ণ, কেদারনাথ থেকে স্থলপথে ২১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এপ্রিল মাসের শেষ থেকে নভেম্বরের প্রথম পর্যন্ত এটি প্রায় ৬ মাস খোলা থাকে, বাকি সময় প্রচণ্ড শীতের কারণে বন্ধ থাকে। ‘চামোলী’ জেলায় অলকানন্দার তীরে অবস্থিত এই মন্দিরের উচ্চতা, প্রায় ১০,২৭৯ ফুট।

‘নরনারায়ণ’ পর্বতের পটভূমিকায় এক সমতল চত্বরে অলকানন্দার তীরে এই মন্দিরের অবস্থান। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা আদি শঙ্করাচার্য। মন্দিরের ঠিক পিছনেই দেখা যায় ত্রিভূজাকৃতি ‘নীলকণ্ঠ শৃঙ্গ’। প্রভাতসূর্যের সোনালী কিরণে ঝলমল করে বরফাবৃত নীলকণ্ঠ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার রং বদলও শুরু হয়। অলকানন্দার উৎস বদ্রীনাথ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ‘অলকাপুরী হিমবাহ’।

মন্দিরের চূড়ায় সোনার কলস বসানো। ভিতরে প্রায় একফুট উচ্চতাসম্পন্ন শালগ্রাম শিলার বিষ্ণুমূর্তি। তার চারদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভক্তরা লাইন দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে, রেলিঙের চারদিক দিয়ে বিষ্ণুমূর্তি প্রদক্ষিণ করে, দূর থেকেই দেবদর্শন করে, প্রণাম করেই, আবার লাইন দিয়ে মন্দির থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়। বিষ্ণুমূর্তি স্পর্শ করার অধিকার ভক্তদের নেই।

মন্দিরের পাশেই রয়েছে এক তপ্তকুন্ড। অনেকেই এখানে স্নান সেরে দেবদর্শন করে। তপ্তকুন্ড ঘিরে রয়েছে পঞ্চশিলা – ‘নারদ শিলা’, ‘নরসিং শিলা’, ‘বরাহ শিলা’, ‘গরুড় শিলা’ এবং ‘মার্কণ্ডেয় শিলা’।

যাক্‌, এতোক্ষণে আমি অলকানন্দাকে খুঁজে পেলাম। বদ্রীনারায়ণ মন্দিরের সামনে অনেক নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে নীলবর্ণা অলকানন্দা। না, ‘বয়ে চলেছে’ বলছি কেন? বলতে হয় – ক্রুদ্ধ হয়ে, সগর্জনে, ভয়াল রূপে, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে – কার খোঁজে কে জানে! আর ওপারে গগনচুম্বি পর্বতমালা তাকে পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, তার গতিপথে কেউ যেন বাধা সৃষ্টি না করতে পারে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম নিচে। তাকে স্পর্শ করলাম, মাথায় ছিটোলাম, তারপর পা ডুবিয়ে তার পাশেই বসে পড়লাম। সেই রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গায় (অনেকটা হরিদ্বারের ‘হর কি পৌড়ি’-র মতো) অনেককেই দেখলাম, সেই উত্তাল, ঠাণ্ডা কনকনে জলে নেমেছে। কেউ পিতৃতর্পণ করছে। কেউ আবার ঘাটে বসে পিতৃশ্রাদ্ধ করছে। বিশ্বাস – এখানে শ্রাদ্ধ বা তর্পণ করলে, পূর্বপুরুষের আত্মা মুক্তিলাভ করে। আমি অবশ্য সেদিকে গেলাম না, অলকানন্দার রূপমুগ্ধ আমি, শুধু তার ধারের সিঁড়িতে বসে তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, যাতে সে আমার বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে না যায়।

বদ্রীনাথ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ‘চরণ পাদুকা’ – যেখানে রয়েছে পাথরের গায়ে ভগবান শ্রী বিষ্ণুর শ্রীচরণ আঁকা। আর ৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ‘মানাগ্রাম’। অনেকেই গাড়ী নিয়ে সেদিকে গেলেন – আমরা অবশ্য গেলাম না।

কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ মন্দিরের পূজারীদের বলা হয় রাওয়ালজী। প্রকৃতপক্ষে এঁরা কেরলের ‘নাম্বুদ্রি’ বা ‘নাম্বুদিরি’ ব্রাহ্মণ।

সন্ধ্যেবেলা আলো ঝলমলে বদ্রীনাথ, চারিদিকের দোকান, বাজার, ভিড়, চিৎকার – এসব দেখে আমার মনে হলো, আমি যেন কলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় বা গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে উপস্থিত হয়েছি। লোকজন কি এখানে দেবদর্শনের বদলে শুধুমাত্র বাজার দোকানই করতে আসে? তখনই মনে পড়লো কেদারের কথা – সেই শান্ত-সমাহিত, নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, ভক্তদের আনাগোনা, কেদারের মহিমা বহুগুণ বর্ধিত করে, তাকে করে তুলেছে অনন্য। মন সেখানে আপনা থেকেই ভক্তিতে নত হয়ে আসে। এসব দেখেই আমার মনে হলো, বদ্রীনাথে দেবতা যেন বন্দি শুধুমাত্র মন্দিরে আর কেদারে তিনি ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। কেদারের নৈঃশব্দ আর গাম্ভীর্য আমায় যতোটা মুগ্ধ করেছে, বদ্রীর ভিড় আর চিৎকার আমায় ততোটাই হতাশ করেছে। তা ছাড়া, কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছতে ভক্তকে কষ্ট করে উপরে উঠতে হয়। কষ্ট না করলে কি দেবতালাভ হয়? আর বদ্রীতে বাস বা গাড়ী ভক্তকে প্রায় মন্দিরের দরজাতেই পৌঁছে দেয়। চারিদিকে দোকান-পাট নিয়ে বদ্রী একটা ভীড়ে-ভিড়াক্কার তীর্থক্ষেত্র।

আমাদের আজকে রাতের অবস্থান বালানন্দ ব্রহ্মচারী আশ্রম। কাল বদ্রীনাথ ছেড়ে এগিয়ে যাবো গঙ্গোত্রীর পথে।

হিমালয় সবারই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে। ভক্ত পায় তার দেবতাকে। ভ্রমণ-পিয়াসী আবিষ্কার করে কোনোও নতুন জায়গা। আর প্রকৃতিপ্রেমী কোনোও রমনীয় প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এতো প্রবাদ, কিংবদন্তী, গল্পকথা পৃথিবীর আর অন্য কোনোও স্থানকে এইভাবে জড়িয়ে আছে বলে আমার অন্ততঃ জানা নেই। এখানে আমাদের মহাকাব্য যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। পৌরাণিক চরিত্র যেন রক্তমাংসের রূপ পায়। প্রকৃতি আর পৌরাণিক কাহিনী হিমালয়কে সত্যিই ‘দেবতাত্মা’ করে তুলেছে। এখানে এলে মানুষ আপনা থেকে পৌঁছে যায় ঈশ্বরের কাছে।

আজ এতোদিন পরে কেদার-বদ্রী স্মৃতিচারণ করতে বসে, আমার সেই অবিস্মরণীয় – বিশেষ সেই দুদিনের কথা, খুব মনে পড়ছে। দুর্লভ সেই দিন – যেদিন ভোরবেলা হঠৎ করেই কেদার দর্শনের সুযোগ ঘটেছিলো আর অতুলনীয় সেই জ্যোৎস্না রাত, যেদিন মন্দাকিনীর সঙ্গে চলছিলো আকাশের চাঁদের লুকোচুরি খেলা। ভাগ্যিস, সেই দুদিন আমি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে ছিলাম, কোনোও পাঁচতারা হোটেলের পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্যে নয়। তাহলে হয়তঃ, এমন দুই আশ্চর্য ও অনির্বচনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকার সুযোগ আমি পেতাম না। এখন হয়তঃ আমি উপলব্ধি করতে পারি, যুগে যুগে সাধকগন কেন কোন্‌ অরূপের সন্ধানে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তুচ্ছ করে ঘর ছেড়ে পথে নামে।

 (কেদার-বদ্রী ভ্রমণ সমাপ্ত)

লেখিকা পরিচিতি
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব সুন্দর ও উপভোগ্য লেখা। যেকোনো ভ্রমণ কাহিনীর পটভূমিতে যদি আলোচ‍্য জায়গাটার বিস্তারিত তথ্য পাঠকের গোচরে আসে তাহলে সেটা একটা বিরাট প্রাপ্তি।
    এই লেখাটি পড়ে অনেক তথ্য জানা গেল।
    লক-ডাউনের বাজারে কিছুটা হাওয়া-বদল হল।
    💐💐💐

    1. তোমার এই লেখাও খুব উপভোগ্য। বেশ ভালো লাগল।

  2. অনেক তথ‍্য সমৃদ্ধ লেখা। ভালো।

  3. কি যে ইন্টারেস্টিং তোমার প্রত‍্যেকটা ভ্রমণ কাহিনী কি বলবো…খুব ভালো লাগছে পড়তে।

  4. তোমাদের ভালো লাগলেই আমার লেখা সার্থক বলে মনে করবো ।

  5. খুভ সুন্দর বর্ণনা। লেখা ত ভাল লাগল। চমৎকার।

Leave a Reply to গোপা মিত্র Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!