Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৫
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৫

গোপা মিত্র

 

 


কাশ্মীর

।। দ্বিতীয় পর্ব ।।

গত পর্বে কাশ্মীর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রেখেই আমি চলে গেছিলাম, এক অলৌকিক (?) ঘটনার বর্ণনায়। আসলে, এই ঘটনাটি আমার কাশ্মীর ভ্রমণের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলো। অবশ্য আমার পাঠককুলের মধ্যে অনেকেই হয়তঃ মনে করেন যে, এতোখানি বিস্তারিত ভাবে এই বিবরণ না দিলেও চলতো – তাদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন এই যে, এই ভ্রমণবৃত্তান্ত একান্তই আমার নিজস্ব ভালো লাগা-মন্দ লাগা, স্বপ্নপূরণ-স্বপ্নভঙ্গ, ঘটনা-দুর্ঘটনা এককথায় আমার অনুভবেরই চিত্রকথা। আমি তথ্যসমৃদ্ধ কোনোও এক উইকিপিডিয়া লিখতে চাই না। আমার অনুভব আমি আমার পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছি মাত্র।

এবারের কাহিনী আমার স্বপ্নভঙ্গের। তার আগে সোনামার্গ, ইউসমার্গের কথাগুলো বলে নিই।

সোনামার্গ অর্থাৎ স্বর্ণভূমি (Meadow of Gold) – প্রাচীনকালের চীন আর সোনামার্গের মধ্যে দিয়েই ছিলো ‘সিল্ক রুট’ (Slik Route)। শ্রীনগর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে গান্ধারবাল জেলায় অবস্থিত সোনামার্গ যাওয়ার রাস্তাটা আশ্চর্য সুন্দর। রাস্তার দৃশ্যপট প্রায়ই বদলে গিয়ে কখনোও দেখা যাচ্ছে বরফাবৃত পর্বতশিখর, কখনোও পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কোনোও নদী। উপর থেকে ঝরে পড়া ঝর্ণা, সবুজ উপত্যকা আর বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম সোনামার্গ।

নির্দিষ্ট জায়গায় ট্যুরিস্ট বাস আমাদের নামিয়ে দিলো আর সময়ও বেঁধে দিলো। আরোও বেশ কিছুদূর যেতে হবে। হয় পায়ে হেঁটে, নয় ঘোড়ায় চড়ে। সময় অল্প, তাই আমরা সকলেই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলাম। ঘোড়া দুলকি চালে আমাদের নিয়ে চললো দূরের এক হিমবাহের দিকে। রাস্তা সামান্য অসমতল হলেও খুব বেশী চড়াই উৎরাই নেই। কিছুদূর গিয়েই দেখলাম একটা সরু নদী বা নালা। ঘোড়া তার মধ্যেই নেমে গেলো। পরে জানলাম, এই নদী বা নালার নাম ‘নালাসিন্ধ’ – এটা ঝিলাম নদীর উপনদী।

নদীর ওপারে আরোও কিছুদূর গিয়ে, দূর থেকেই অনেক অনেক দূরে সেই হিমবাহ দেখে, সময়মতো বাসের কাছে পৌঁছবার জন্যে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। পাহাড়, নদী, আশপাশে ছড়ানো-ছিটানো বরফ, সবুজ উপত্যকা, দূরের হিমবাহ সমৃদ্ধ ছবির মতো সোনামার্গ আমার মনে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।

সোনামার্গ থেকে সামান্য দূরেই রয়েছে বালতাল। শুনলাম, ওর মধ্যে দিয়ে সংক্ষিপ্ত এক পথ চলে গিয়েছে অমরনাথের দিকে। অবশ্য সেই পথ জনগনের জন্যে নয়, শুধুমাত্র ভারতীয় জওয়ানদের যাতায়াতের জন্যেই ব্যবহৃত হয়। জানি না এই ব্যবস্থা চালু আছে কি না।

পরদিন যাত্রা ইউসমার্গে। শ্রীনগর থেকে ইউসমার্গ বাসে প্রায় দু-আড়াই ঘন্টার পথ। পাইনগাছ পরিবেষ্টিত, সবুজ বিস্তীর্ণ প্রান্তর, বয়ে চলা নদী, জলাশয় সমৃদ্ধ ইউসমার্গের শান্ত-সমাহিত সৌন্দর্য উপভোগ করার একমাত্র উপায়ই হলো নীরবতা।

কাশ্মীর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, গুলমার্গ বা পহেলগাঁও না গেলে। প্রথমেই স্বপ্নভঙ্গ – গুলমার্গ।

গুলমার্গের কথা ভাবলেই ছবিতে দেখা গুলমার্গের কথা মনে পড়ে। তার চারিদিকেই বরফ – বলা যায়, বরফাবৃত, আর তার মাঝে স্কি করে চলেছে দেশী-বিদেশী পর্যটক। এই স্বপ্ন নিয়েই আমরা চেপে বসলাম ট্যুরিজমের বাসে। গুলমার্গ যাবো, বরফের ওপর হাঁটবো, এই চিন্তা করেই প্রথমবার সঙ্গে এনেছি শার্ট-প্যান্ট। কল্যাণের পুরনো শার্ট-প্যান্ট দর্জিকে দিয়ে কাটিয়ে-কুটিয়ে নিজের মাপ মতো করে নিয়েছি।

শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বাস ছুটে চলেছে। রাস্তার পাশের গাছপালা, বাড়ি-ঘর, আপেল বাগান উল্টোদিকে ছুটে চলেছে। আমি বিভোর আমার স্বপ্নে।

অবশেষে বাস থামলো। কিন্তু কোথায় গুলমার্গ? আমি তো চিনতেই পারছি না। নুড়ি-পাথরে ঢাকা এক অসমতল রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ন্যাড়া পাহাড় – ধারে কাছে বরফের চিহ্নমাত্রও নেই। জিজ্ঞেস করে জানলাম, বরফ আরোও ওপরে গেলে তবেই দেখা যাবে। যেতে হবে হুয় পায়ে হেঁটে, নয় তো ঘোড়ায় চড়ে। বাঁধা সময়ে আমরা কোনোও ঝুঁকি নিলাম না। সকলেই ঘোড়ায় সওয়ার হলাম। ঘোড়া এগিয়ে চললো তার নিজস্ব গতিতে চড়াইয়ের পথে। এখানে একটা কথা বলা হয়তঃ অপ্রাসঙ্গিক হবে না, পাহাড়ে ওঠা বা চড়াই পথে ঘোড়ায় চলা দুক্ষেত্রেই সামনে সামান্য ঝুঁকে চলতে বা বসতে হয়। আর উৎরাইয়ের পথে ঠিক বিপরীত – পিছনে হেলে নামতে বা বসে থাকতে হয়। না হলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

আমার ঘোড়া সব চেয়ে আগে। অসিতদা কল্যাণকে বললেন, “গোপাকে অতো এগিয়ে যেতে বারণ কর্‌।” কিন্তু কল্যাণের উত্তর আমি শুনতে পেলাম, “যাচ্ছে যাক্‌। আমরা তো সবাই এক জায়গাতেই পৌঁছবো, অতো চিন্তার কিছু নেই।” আমি জানি কল্যাণ আমায় ভরসা করে, যে কোনোও পরিস্থিতিতেই নিজেকে উদ্ধার করবার ক্ষমতা আমার আছে – এ কথা সে বিশ্বাস করে।

অবশেষে এক জায়গায় এসে ঘোড়া থামলো। চারিদিকে ন্যাড়া পাহাড়ের মাঝে সামনের একটা জায়গা নির্দেশ করে সহিস বললো, “ওই দেখুন, সামনে বরফ।” সম্ভবতঃ সেই জায়গাটা খিলেনমার্গ, আর আমাদের সামনে রাস্তা আগলে পড়ে রয়েছে এক মলিন হলদেটে ফাটল ধরা আয়তাকার বরফের চাঁই।

এই না কি গুলমার্গ – বরফে ঢাকা! এই গুলমার্গের স্বপ্নই না কি আমি এতোদিন দেখে এসেছি! এর জন্যেই কি আমরা এতোদূর ছুটে এসেছি। এর আগেই তো আমার রোটাং পাসে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা হয়ে গেছে। কাজেই বরফ কাকে বলে আমি বেশ জানি। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে আমি ফিরে চললাম শ্রীনগর। কাল আবার এক নতুন সকাল, নতুন জায়গা।

কাশ্মীরের দর্শনীয় সব স্থানেই আমরা গিয়েছি ট্যুরিজমের আরামদায়ক বাসে – সব ক্ষেত্রেই সঙ্গে ছিলো গাইড। শ্রীনগরের বিখ্যাত মসজিদ হজরতবালে রয়েছে হজরত মহম্মদের পবিত্র কেশ – তাও একদিন দেখে এলাম।

বিখ্যাত হস্তশিল্প বাজার লালচক থেকে আমরা কিনলাম আমাদের পছন্দমতো কাশ্মীরী শাল, আখরোট কাঠের কাজ করা ও পেপার মেচ দিয়ে তৈরী নানারকম উপহারসামগ্রী ও রংবেরঙের পাথরের গয়না। এদের কার্পেটগুলিও খুব সুন্দর, তবে আনার অসুবিধে বলে নিলাম না।

অনন্তনাগ জেলায় অবস্থিত পহেলগাঁও, লীডার নদীতীরবর্তী এক ছোট্ট শৈলশহর। উচ্চতা ৭২০০ ফুট। প্রকৃতির অকৃপণ দানে সজ্জিত পহেলগাঁওর চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে পাহাড় – কোনোওটা খয়েরী, কোনোওটা সবুজ আবার কোনোওটাও বা বরফে চক্‌চকে। একেবারে পাশ দিয়ে উপলবন্ধুর পথে বয়ে চলা, স্বচ্ছ্ব কলস্বনা লীডার নদী, মাঝে মাঝে অযত্ন বর্ধিত কোনোও ঘাসজমি বা বৃক্ষরাজির জঙ্গল – পগেলগাঁওকে ছবির মতো সাজিয়ে তুলেছে। একেই বোধ হয় বলে Picture Perfect। এতোদিনে মনে হলো কাশ্মীরে এসে আমি কোনোও ভুল করিনি। না এলে তো পহেলগাঁও দেখা হতো না! আমার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হলো।

আর তো মাত্র দু-একটা দিন। চেষ্টা করি, যতোটা পারি, লীডার নদীর সঙ্গে সময় কাটাতে। লীডার নদী সঙ্গী করে হেঁটে যাই যতোটা পারি দূরে – কানে বাজে নদীর সুমধুর কুলু-কুলু ধ্বনি। আবার ফিরে আসি শুরুতে। চেনা পথ, চেনা নদী – তবুও প্রতি মুহূর্তে নতুন করে আবিষ্কার করি তাকে।

১৬ কিলোমিটার দূরের চন্দনওয়াড়ি, যেখান থেকে শুরু হয় অমরনাথ যাত্রা – ঘোড়ায় চড়ে সেখান থেকেও ঘুরে এলাম। এমন কিছু অসাধারণ মনে হলো না। আমি জানি, আরোও ওপরে অমরনাথের যাত্রাপথ যেমন সুন্দর, তেমনই দারুণ কষ্টসাধ্য।

কেটে গেলো তিনটে দিন। এর পর শ্রীনগরে ফিরে এসে মুখোমুখি হলাম সেই বিশেষ অলৌকিক ঘটনাটির, যার বিস্তারিত বিবরণ আমি আগের পর্বে দিয়েছি। তারপর আমরা ফিরে চললাম কলকাতার পথে। মন জুড়ে আছে লীডার নদী আর বুক ভরে আছে নির্মল বাতাসে। এই বাতাস কলকাতায় আমাকে অনেকদিন সুস্থ রাখবে। তারপর হয়তঃ আবার বেরিয়ে পড়বো, নতুন কোথাও বিশুদ্ধ অক্সিজেনের খোঁজে।

কাশ্মীর ভ্রমণে আমার পাওনা পহেলগাঁও। শ্রীনগর আমার বড় বেশী কৃত্রিম লেগেছে। সব যেন মানুষের সাজিয়ে দেওয়া। মুঘল গার্ডেন্সের সৌন্দর্য – সেও তো মানুষেরই সাজানো। তা ছাড়া পর্যটকদের ভিড়, বেমানান বড় বড় হোটেল বা ব্যপারীদের কোলাহল শ্রীনগরের স্বাভাবিক সৌন্দর্য অনেকটাই হরণ করেছে। সোনামার্গ ও ইউসমার্গ অবশ্য ব্যতিক্রম, তবে সেও তো শ্রীনগরের এক খণ্ড প্রকৃতির সৌন্দর্য।

জানি না, আবার কোনোওদিন অপরূপ এই পহেলগাঁওতে আসা হবে কি না। আবার কোনোওদিন লীডার নদী সঙ্গে নিয়ে হাঁটা হবে কি না। বহমান জীবন আমায় কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে এটাই তো আমার এখনোও অজানা!

— কাশ্মীর ভ্রমণ দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত —

 



গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। এক সময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

 

 

 


 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. অনেক পুরোনো দিনের স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।
    খুব ভালো লাগল।।💐💐💐💐💐💐💐💐

  2. লেখাটা রচনা লেখার মতো হলে, আকর্ষন থাকেনা। তাই সেদিকে একটু নজর দিতে হবে।

    1. ঠিক বুঝলাম না । একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়।

      1. এবারের লেখাটা আমায তেমন ভাবে টানেনি। এটাই বলতে চেয়েছি। বর্ণনা ছাড়াও আরও কিছু স্বতস্ফূর্তভাবে আসে, সেই অভাবের কথা বলতে চেয়েছি। অবশ‍্য ই আমার নিজস্ব মতামত এটা। আমি ঠিক নাও হতে পারি।

  3. সুন্দর বর্ণনা, ভাষা চমৎকার । এতদিন আগের এত details খুব ভালো লাগলো । পাকা লেখিকা।

  4. এত ভালো লেখা, এত সাবলীল যে পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চমৎকার বললেও কম বলা হয়।পরবর্তী এপিসোড গুলো অবশ্যই পড়ব। অন্যান্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply to Jayantanuj Ghosh Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!