অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তিরিশ বছর দিল্লীবাসের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই উত্তুরে লোকগুলির অনেকেই লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্টে আপনার সাথে কোনোকারণে হঠাৎ দেখা হলে বলে উঠবে, “আও, খানা খাও”। আর বিনিময়ে মনে মনে অবশ্য প্রত্যাশা করবে আপনি লাজুক হাসিতে ঘাড় নেড়ে বলবেন, “নেহি নেহি, আপ হি লিজিয়ে…”। এটিকে বলা যেতে পারে, “উত্তরভারতীয় শান্তিপুরী”, বা “উত্তুরে খেজুর”।
তখন সবে মাত্র উদ্বাস্তু হয়ে দিল্লী এসেছি। এক সম্ভ্রান্ত পাড়ায় ভাড়া বাড়ির বরষাতিতে থাকি। বাড়ির মালিক মিশ্রাজি আমায় বড় ভালবাসতেন। তাঁর যত ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার, সব তিনি বাড়ির বারান্দায় নেয়ারের খাটিয়ায় বসে সেরে নিতেন। পরিবারের সবাই একই জায়গায়, কেউ চেয়ারে, কেউ টুলে, কেউবা খাটিয়ায়, দিনভর খাওয়া দাওয়ার পালা সারত। বেচারা ডাইনিং টেবিল গৃহশোভা হয়ে, তাদের ঘরের এককোণে মন খারাপ নিয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকত।
আমায় দেখলেই ভোজনরত মিশ্রাজি ডান হাতে ছেঁড়া রুটির টুকরো তুলে ধরে বলে উঠতেন, “আও, খানা খাও!” আর আমিও সেই লাজুক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ঘাড় গুঁজে, খিদেয় মোচড়ানো পেট নিয়ে পাশ কাটাতে বাধ্য হতাম। কখনো কখনো মন প্রতিবাদি হয়ে বলে উঠতে চাইত, “আচ্ছা, লাইয়ে, এক হাত ম্যায় ভি……”। কিন্তু ওই, আজন্ম শিকড় ছড়ানো মধ্যবিত্ত মানসিকতা আমার সামনে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে প্রহরীর মতো।
আরও কিছু বছর কেটে গেছে। সে পাড়া ছেড়ে, সরকারি বাসস্থানে থাকি তখন। আমাদের পাড়ায় ছিল বনেদী এক লণ্ড্রী। বনেদী বললাম, কারণ সে লণ্ড্রী নাকি ব্রিটিশ আমল থেকে বিরাজমান। তা সে লণ্ড্রীর মালিক সেই একই “উত্তুরে খেজুর” করত। জামাকাপড় নিয়ে হাজির হলেই বলে উঠত, “চায়ে চলেগি সাব? একদম্ স্পেশাল!” আবার সেই আমার ভিতরে বাস করা মধ্যবিত্ত জীর্ণ মানুষটি মুখ ব্যাজার করে বলে উঠত, “নেহি নেহি, জানা হ্যায়, ফির কভি…”। আর উনিও পেশাদারী মুখব্যাদানে সহায়ককে ধমকে উঠতেন, “জলদি নিকাল বাবুজি কে কাপড়ে!” আর চা বিলাসী আমার ভিতর ঘুমিয়ে থাকা প্রতিবাদের কুকুরটা নিঃশব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠত, “তেরি ত্তো! কাপড়ে নিকালুঙ্গা তেরি। আভি লা চায়ে”। তবে আমার মুখ দেখে সেসব কিছুই বোঝা যেত না।
একদিন কেন জানি না, যেই শুনেছি, “চায়ে চলেগি সাব? একদম স্পেশাল গরমা গরম…”, ঘাড় সম্মতি সুচক ভাবে আশ্চর্য রকমভাবে নড়ে উঠল। মুখ বলে উঠল, “লাইয়ে, আজ ম্যায় ভি……”। মুহূর্তে নিভে গেলো লণ্ড্রী মালিক বৃদ্ধটির মুখের আলো। শুধু যে নিভে গেলো তাই না, আষাঢ়ের মেঘ নেমে এলো। কঠিন গলায় তিনি বালক ভৃত্যটিকে হুকুম দিলেন, “ছোটু, যা এক কাপ চা, মালাই মার কে…”।
মালাই মারা সেই চা আর আসে না। বসে আছি তো আছিই। লণ্ড্রীতে মানুষের আনাগোনা, মালিকের হাঁকডাক, শুনছি, দেখছি, বসে আছি। চা আর আসে না। আমারও জেদ। মনে মনে লণ্ড্রী মালিকের এইসি কি ত্যায়সি করছি। ভাবছি, “তুম হামে জানতে নেহি হো! হাম মফস্বল কে বাংলা মিডিয়াম স্কুল মে পড়কে আয়ে হ্যাঁয়। আজ চায়ে পিকে হি জায়েঙ্গে”।
বহু প্রতীক্ষিত ‘চায়ে’ এলেন। কিন্তু মালিকের মতোই ততক্ষণে ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে। এরপর থেকে বুড়োকে কোনদিন আর বলতে শুনিনি, “চায়ে চলেগি সাব? একদম স্পেশাল!”
তাহলে শুধু শুধু শান্তি (পুর বা নিকেতন) এর দোষ কেন?রাজধানীর ও নাম থাক।
উত্তর ভারতীয় শান্তিপুরী ভদ্রতার নমুনা জেনে বিস্মিত হলাম। তবে আপনিও মফস্বল কে বাংলা মিডিয়ামে পড়কে আচ্ছা জব্দ কিয়া হ্যায়।
চমতকার বললে
বহত বঢ়িয়া লিখা হৈ আপনে পর হম বনারসী ওয়ালে ঐসে নহি হৈ সাব।
ঠিক বেরিয়ে আসার সময়, “আইয়ে খানা খাকে যাইয়ে”, এমন শান্তিপুরী আহ্বান হিমাচল, হরিয়ানা, পাঞ্জাবে অজস্রবার শুনেছি। না কোনদিনই সে ডাকে সাড়া দিইনি। তবে চা, স্ন্যাক্স, সামোসা, এমনকি পাঁচকুল্লায় এক জনের বাড়িতে সন্ধেয় হুইস্কি-কাবাবও খেয়েছি।
লেখাটা খুব ভালো লাগল – মনে পড়ে গেল অনেক অভিজ্ঞতা।
খুব ভালো লাগলো। চা কে কেন্দ্র করে এত সুন্দর লেখা সত্যি ই মনোগ্রাহী। শুভেচ্ছা সহ।।