Home বিবিধ, গল্প শেষ চিঠির দিন
বিবিধগল্প

শেষ চিঠির দিন

ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য

ভোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। অগাস্টের কলকাতা—আকাশটা কেমন নীল-ধূসর হয়ে থাকে এই সময়টায়। কুঁচকে যাওয়া হাতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে ছিলেন প্রবীরবাবু — অবসরপ্রাপ্ত ডাক বিভাগের কেরানি। পাড়ার লোকে তাকে “পোস্টমাস্টারদা” বলেই জানে, যদিও জীবনে পোস্টমাস্টার পদটা তিনি পাননি কোনোদিন।

টিভিতে খবর আসছিল—“সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫ থেকে বন্ধ হচ্ছে রেজিস্টার্ড পোস্ট পরিষেবা। ভারতীয় ডাক বিভাগ এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে…”

প্রবীরবাবু শুনে বললেন, “এ তো এক প্রিয়জনের শ্রাদ্ধ সংবাদ।” পাশে বসা তার নাতনি তৃষা বলল, “দাদু, তুমি না সব সময় ড্রামাটিক হয়ে যাও! আজকাল কেউ চিঠি লেখেও না।”

প্রবীরবাবু সাড়া দেন না। জানালার বাইরের বৃষ্টিটাকে দেখছিলেন—হয়তো তাঁর মনেও একটা মেঘ জমেছে।

১৯৮১ সাল। চন্দ্রাবতী ঘোষ নামে এক মেয়ের সঙ্গে প্রবীরবাবুর আলাপ হয়। কলেজে পড়তেন তখন। চিঠি লিখতেন, কবিতা পাঠাতেন। কিন্তু সেই সব চিঠি বিয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একদিন। চন্দ্রার বাড়ির লোক একদিন সেই চিঠি খুলে পড়ে—ভীষণ ঝড় বয়ে যায় পরিবারে। বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ।

তারপর?

প্রবীরবাবু তবু থেমে থাকেননি। সাহস করে ৩টি রেজিস্টার্ড চিঠি পাঠিয়েছিলেন—প্রতিটিতে শুধু একটি বাক্য লিখেছিলেন:

“এই চিঠি শুধু আমার ভালোবাসার নয়, আমার বিশ্বাসেরও। পৌঁছালে জানবো, তোমার কাছে পৌঁছেছি।”

শেষ চিঠিটা ডেলিভার হয়েছিল—আর সেই চিঠির ডেলিভারি স্লিপটা তিনি আজও আগলে রেখেছেন।

চন্দ্রা এসেছিলো এক সন্ধ্যায়, নিঃশব্দে। বলেছিলো—“তোমার লেখা চিঠি যত না প্রেমের, তার চেয়েও বেশি নির্ভরতার, দায়িত্বের।” সেই চিঠিই তাদের জীবনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৫০ বছর পার করে দিয়েছে তাদের সম্পর্ক।

বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন প্রবীরবাবু পোস্ট অফিসে—পাতিপুকুর শাখা। কবে কার চিঠি হারিয়ে গেছে, কারটা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে, কে কাঁদতে কাঁদতে কি বলেছে? “মেয়ের আর্তি, কবে  চিঠি পৌঁছোবে বাবার কাছে?”—সব মনে আছে তাঁর। প্রতি বছর কয়েকটা চিঠি ফিরত—“Left”, “Address Not Found”, “Refused” লেখা সিল মারা খামে। কেউ কেউ এসে সেই খাম খুলে কাঁদত, কেউ বা হেসে বলত—“ঠিকই ছিল, ভুল ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম শুধু।”

প্রবীরবাবুর মতে, “রেজিস্টার্ড পোস্ট মানে শুধু চিঠি নয়—একটা দায়বদ্ধতা, একটা সাক্ষ্য। সেই স্বাক্ষর, সেই রসিদ যেন একজন মানুষ বলে উঠছে—‘হ্যাঁ, আমি এই কথাগুলো গ্রহণ করেছি।”

তিনি  মনে মনে বলেন, “চিঠির একটা গন্ধ ছিল—পুরনো কাগজ, কালির দাগ, হাতের ছাপ। চিঠিতে মনের মতো “দেখা” দেওয়া যেত। আর রেজিস্টার্ড পোস্ট মানেই দেখা দেওয়ার সাক্ষী। সেই সাক্ষীটা উঠিয়ে নেওয়া হবে—তাদেরকে না জিজ্ঞেস করেই?”

সেপ্টেম্বরের ঠিক আগের সপ্তাহ। প্রবীরবাবু একটা সিদ্ধান্ত নেন। একটা চিঠি লেখেন নিজের হাতে—পেন দিয়ে। তৃষা অবাক হয়ে দেখে, দাদু আবার খাতা খুলেছে।

চিঠির প্রাপক? চন্দ্রাবতী দেবী।

লেখেন:

“প্রিয় চন্দ্রা,

আজ জানি না তুমি এখনও চিঠির অপেক্ষা কর কিনা! আমরা আজ একসঙ্গে আছি সেই রেজিস্ট্রি চিঠির জন্য, আর এখন সেই যুগ শেষ হতে যাচ্ছে—যে যুগে একটা চিঠি মানে ছিল হাত ধরে কথা বলা। আজ শেষবারের মতো তোমাকে চিঠি লিখলাম, রেজিস্টার্ড করলাম। জানি, তুমি তো আমার পাশেই আছো। তবু এই চিঠিটা যেন তোমার বিশ্বাসের ঠিকানায় পৌঁছে যায়।

তোমার প্রবীর”

চিঠিটা প্যাক করেন, নাম, ঠিকানা লেখেন, ডাকটিকিট লাগান, আর শেষে গিয়ে সোজা পোস্ট অফিসে জমা দেন। পাতিপুকুর পোস্ট অফিসটা এখন কেমন বেমানান লাগছে। এক কোণে কাগজের বান্ডিল, আরেক কোণে কম্পিউটার।

নতুন ছেলে এসেছে—রূপম। তাকে বলেন চিঠিটা রেজিস্টার্ড করে দিতে।

রূপম একবার খামটার দিকে তাকায়, তারপর বলে, “দাদু, এটা হাতে হাতে দিলে তো সহজ হত, এখন তো প্রাপক আপনার বাড়িতেই থাকেন!”

প্রবীরবাবু মুচকি হেসে বলেন,

“জানি। তবু শেষবারের মতো চিঠিটাকে সেই পথেই পাঠাতে চাই, যে পথটা একদিন আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।”

রূপম হাসে, কিছু বলে না। চিঠি নেয়, রসিদ দেয়। রসিদটা লাল কালি দিয়ে সই করে দেন প্রবীরবাবু। অভ্যাসমতো।

পেছনে দাঁড়ানো এক যুবক টাকা জমা করতে করতে জিজ্ঞেস করে, “দাদু, এখন তো সবাই হোয়াটসঅ্যাপ করে, আপনি নিজের বউকে এখনো চিঠি পাঠাচ্ছেন?”

প্রবীরবাবু মুচকি হেসে বলেন,

“হ্যাঁ বাবা। এটা শেষ রেজিস্টার্ড পোস্ট, শেষ বার্তা। জীবনের সবটাই তো আর ডিজিটাল হয় না।”

সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫। চন্দ্রাবতী দেবী ঘুম থেকে উঠে দেখেন, টেবিলে রাখা একটা খাম।

প্রেরক: প্রবীর ঘোষ

ডাকের তারিখ: ২০ আগস্ট ২০২৫

পরিষেবা: REGISTERED POST

চন্দ্রা নিঃশব্দে খামটা খোলেন, পড়েন। চোখ দিয়ে জল পড়ে না, পড়ার দরকার পড়ে না—চোখের কোণে শুধু একটুখানি সময় জমে থাকে। তিনি আস্তে করে বলেন, “ধন্যবাদ তোমায়, রেজিস্টার্ড পোস্ট। তুমি আমাদের ভালোবাসা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলে।”

সন্ধ্যায় চন্দ্রা এসে প্রবীরবাবুর পাশে চুপচাপ বসে পড়েন। জিজ্ঞেস করেন না চিঠির কিছু, বলেনও না কিছু। তবে চোখে এক ধরনের প্রৌঢ় উষ্ণতা। যেন জিজ্ঞেস করছেন— “তুমি কি এখনো চিঠির মতো করেই ভালোবাসো?”

প্রবীরবাবু পকেট থেকে রসিদটা বের করে টেবিলে রাখেন। “তোমার কাছে যদি পৌঁছোয়, বুঝবে—এখনো বিশ্বাস করি পৌঁছোনো যায়। রেজিস্টার্ড পোস্ট আর থাকবে না—হয়তো সময়ের নিয়মে ঠিকই। কিন্তু কিছু ভালোবাসা চিরকাল রেজিস্টার্ড হয়ে যায়—মানুষের হৃদয়ের পোস্ট অফিসে।”

রেজিস্টার্ড পোস্ট বন্ধ হচ্ছে—হয়তো প্রযুক্তির প্রগতিতে তার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রবীর-চন্দ্রার মতো হাজারো জীবনে, সে এক চিরন্তন সাক্ষী হয়ে থাকবে। সেইসব চিঠিগুলোর মধ্যে ছিল ভরসা, অপেক্ষা, ক্ষমা, ভালোবাসা—যা কোনো মোবাইল অ্যাপ ধারণ করতে পারবে না। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো শিশু যখন দাদুর আলমারি থেকে পুরোনো একটা রেজিস্টার্ড খাম বা রসিদ খুঁজে পাবে—সে কি বুঝবে, এসব চিঠি মানে কেবল লেখা নয়—একটা অনুভব, যা সময়কেও ছুঁয়ে যেতে পারে!

লেখক পরিচিতি

Dr. Dipra Bhattacharya

Management Consultant & AI Strategist

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. অসাধারণ! খুব প্রাসঙ্গিক লেখা। ঐতিহাসিক তো বটেই…
    ইতিহাস যেমন সৃষ্টির হয়, ঠিক তেমনই ধ্বংসেরও হয়।
    আজকের তারিখটা (১লা সেপ্টেম্বর, ২০২৫) ধ্বংসের ইতিহাস হিসাবেই গণ্য হওয়া উচিত।

  2. এত রূঢ় বাস্তব এক ঘটনা নিয়ে এমন আবেগময় লেখাও যে সম্ভব তা এই গল্পটি না পড়লে জানতাম না। বেশ কিছু কথা মনে রাখার মতো। তারমধ্যে অন্যতম চোখের কোণে সময় জমে থাকা। অসাধারণ লেখা।

    1. লেখক এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং এটার মাধ্যমে ওনার ঠাকুরদা, যিনি কলকাতা জি পি ও তে কর্মজীবন কাটিয়েছেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।

  3. অসাধারণ লেখা। ইতিহাসে লেখা থাকবে ০১/০৯/২০২৫ #ডাক বিভাগের কালো দিন।

  4. লেখক এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং এটার মাধ্যমে ওনার ঠাকুরদা, যিনি কলকাতা জি পি ও তে কর্মজীবন কাটিয়েছেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।

  5. লেখাটা অসাধারণ লাগলো। বাস্তব পটভূমিতে এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি করলো। মনে রাখার মতো এক অকৃত্রিম ভালোবাসার গল্প পেলাম। শুভেচ্ছা জানাই।

    1. খুব ভালো লাগলো । পিছনে ফিরতে মন চায় । এক সময় চিঠি বন্ধু ছিল, নস্টালজিক লাগে ।

  6. খুব ভালো গল্প।একটা যুগ শুধু নয়, একটা মূল্যবোধেরও ইতি — এই অনুভূতি এই গল্পের প্রাণভোমরা।

  7. অসাধারণ এক মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। পোস্ট অফিস, ঠিকানা লেখা খাম, চিঠি লেখা, চিঠির উত্তরের অপেক্ষা সবই হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। তাও তো তার রেশ রয়ে যায় মনে। রেজিস্টার্ড পোস্ট তুলে নেওয়া কে কেন্দ্র করে এই লেখায় সেটাই ফুটে উঠলো । ভালো লাগলো।

  8. খুব সুন্দর একটি গল্পের জন্য সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ।এই গল্পটি প্রকৃতপক্ষে একটি মূল্যবোধের গল্প। লেখক এই উপলব্ধি মূর্ত করেছেন দুর্মর ভালোবাসায়।

Leave a Reply to Swati Ray Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!