Home সামাজিক, গল্প মামা ভাগ্নে ও পয়লা বৈশাখ
সামাজিকগল্প

মামা ভাগ্নে ও পয়লা বৈশাখ

লেখিকা: সুদেষ্ণা মিত্র


 

পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল ছোটবেলায় নতুন জামা পরে মামারবাড়ী যাওয়া। আমার বাবা যেহেতু জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত ছিলেন তাই নববর্ষের দিনে পুরো ছুটির মজা আমরা ভোগ করতে পারতাম না। সকালে বাবা অফিসে যেতেন আর দুপুরবেলা ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের নিয়ে মামারবাড়ী যেতেন, কোনোও কোনোও বার ছোটোমাসির বাড়িও যাওয়া হোতো। কারন আমার মামা এবং মেসোমশাই দুজনেই ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই হালখাতার খাওয়াদাওয়া নেহাত মন্দ হতো না। এই রুটিনমাফিক নববর্ষ কাটানোর ঘ্টনা কিন্তু বহুবছর ধরে বদলায়নি। শুধু কখনো কখনো সকালের দিকে দুই ভাইবোন মিলে দাদুর সাথে তাঁর এক চেনা মিষ্টির দোকানে যেতাম। সেটা ছিল শ্যামবাজার অঞ্চলে। বেশ অনেকটা রাস্তা বাসে করে যেতে হোতো। খুব অস্পষ্ট মনে পড়ে বাস এর জানলা দিয়ে তাকিয়ে বাইরে ভীড় ঠাসা দোকান দেখলেই দাদুকে দেখাতাম। বাড়ী ফিরে আসতাম মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেণ্ডার নিয়ে। কতক্ষণে বাড়ী ফিরে ক্যালেণ্ডার দেখবো সেটাই ছিল চরম উত্তেজনা।

১৯৭৯ সালের অগস্ট মাসের কোনোও এক তুমুল বৃষ্টির দিনে আমাদের প্রথম গাড়ি এলো বাড়িতে। ধোঁয়াটে সাদা অ্যাম্বাসাডার মার্ক টু, যার নম্বর ছিলো ৮৩৪৪। প্রায়ই তখন নানা ছুতোনাতায় গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন বাবা। সেরকমই পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮০ সালের ১৪ই এপ্রিল, বাংলা ১৩৮৭ সনের পয়লা বৈশাখ ঠিক হলো যে পিসি আর আমার পিসতুতো ভাইকে নিয়ে আমাদের আর এক দাদুর বাড়ি বেহালায় যাওয়া হবে। এখানে বলা দরকার আমার পিসির ছেলে সোমদেবের তখনও দুই পূর্ণ হতে কদিন বাকি আছে। সবেমাত্র সে কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই ছিলো যে, সে আধো আধো কথা না বলে পুরো বড়োদের মতো কথা বলতো। আমার বাবার সে চোখের মনি। অতো ছোট বয়েসেই সে গাড়ী পাগল। মামাও তাই সারাক্ষণই ভাগ্নে কে গাড়ী করে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার বাহানা তৈরি করতো। সোমদেব ছোট থেকেই বুঝে গেছিলো যে তার মাম্বু আসা মানেই গাড়ী চড়া। পিসি র কাছে গল্প শুনেছি সে নাকি মাঝে মাঝেই জানলার গ্রীলে উঠে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিছু জিগ্যেস করলে বলতো মাম্বু আসছে গাড়ী নিয়ে। তাই সে বছরের পয়লা বৈশাখের জন্যে শুধু আমি আর আমার ভাই নই, সোমদেবও যথেষ্ট আগ্রহী ছিলো বেড়াতে যাবে বলে। আর শুধু তারই জন্যে তার মাম্বু এতবছরের নিয়ম বদলে আমাদের মামারবাড়ী যাওয়ার জায়গায় দাদুর বাড়ী যাওয়ার ঠিক করলেন। মনে পড়ে সেদিন পিসি সকালে সোমদেবকে নিয়ে চলে এলো আমাদের বাড়ীতে। পিসি আর ভাই এলে আমরা খুবই খুশি হতাম। বয়েসের ব্যবধান যাই হোক, আমরা মেতে থাকতাম নিজেদের দুষ্টুমি আর আনন্দতে। সেদিনও তার ব্যাতিক্রম হল না। সব ঠিকই ছিল কিন্তু অফিসে কিছু গণ্ডগোলের কারণে দুপুরবেলা বাবা অন্যবারের মতো খেতে আসতে পারলেন না। বিকেলবেলা হঠাৎ বাবা ফোন করে বললেন যে কিছুতেই অফিস থেকে বেরতে পারছেন না; তাই আমাদের বেড়াতে যাওয়া আজ সম্ভব নয়। আমাকে আর ভাইকে বাবা বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলেন। আমি ভাই দুজনেই তখন ছোট। আমরা বেশ ঝামেলা করতে শুরু করলাম। ফোনটা আবার বেজে উঠল। বাবারই ফোন। তার প্রিয় ভাগ্নের সাথে কথা বলবেন। সোমদেব বিজ্ঞের মতো ফোন ধরে কথা বলতে শুরু করল। কে জানে অন্য প্রান্ত থেকে তার মাম্বু তাকে কি বললো, উত্তরে এদিক থেকে ভাগ্নে জিজ্ঞেস করলো “৮৩৪৪ আসবে না আজ!!” ওইটকু ছেলে এইভাবে গাড়ীর নম্বর মনে রাখতে পারে, তা বোধহয় কেউই ভাবতে পারেনি।

তার পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। প্রিয় ভাগ্নের মনখারাপকে উপেক্ষা করতে না পেরে মাম্বু ফিরে এলেন, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে। আমরা নতুন জামা পরে রেডি হয়ে সবাই মিলে বেড়লাম ঘুরতে কাছের টালা পার্কে। যেখানে আগে কোনোদিন যাওয়া হয়নি কেন, তা কেউই জানেনা। চোখের সামনে এখনও ভাসে টালা পার্ক,‌ তার বিরাট বড় গেট আর সুন্দর করে সাজানো গাছগাছালী। আইসক্রিম আর ফুচকা ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়েছিল কিনা সে বছর নববর্ষে আমার মনে নেই, কিন্তু এটা মনে আছে সারা রাস্তা সোমদেব গাড়ীর চালক তার মাম্বুর পাশে অবাক বিস্ময়ে বসে ছিল। তার সেই চোখের ভাষা আমার মনের মণিকোঠায় এখনও জ্বলজ্বল করছে।

 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. Darun sundar. Purono diner sab katha mone pore jachhe.Montemamar katha khub mone pare. Mama o maima dujonkei khub miss kori amra. Jolu masir sange anekdin dekha hoye na. Dekhte khub ichhe kore.

  2. kaku ebar gele tomar sathe dekha korbo. sabdhane theko. ar amader blog porte theko. tomar lekha ekhane chapte chai.

  3. Khub bhalo laglo tor sob tai mone ache dekhchi puronodiner kotha oboshoye bhola jayna. Anjan mitrader kotha khub mone pore.Amra ki sundor din kataitam.J

  4. ভীষন ভালো লাগলো রে।বড্ড তাড়াতাড়ি যেন শেষ হয়ে গেলো লেখা টা । আরো চাই

  5. অপূর্ব ! পুরনো সব কথা মনে পড়ছে। আজ সারা দুপুর দাদাকে স্বপ্নে দেখেছি। একদম এই বয়সের এই চেহারায় আমার হাতটা ধরলো। সবাই মিলে যেন রাতের খাবার খাচ্ছি। আবার যদি সেই দিনগুলো ফিরে পেতাম !

Leave a Reply to Ritwick Ray Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!