Home বিনোদন, প্রবন্ধ ৫০শে কলকাতা দূরদর্শন
বিনোদনপ্রবন্ধ

৫০শে কলকাতা দূরদর্শন

সৃজিত্‌ মিত্র

সালটা ১৯৭৫…

আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে…

আজকের প্রজন্মের কল্পনায় সে যুগ ঠিকঠাক ধরা পড়া যথেষ্ট কষ্টকর।

মোবাইল ইন্টারনেট তখন অজ্ঞাত বস্তু, কম্পিউটার বলতে অধিকাংশ মানুষই বুঝতো বিশালাকৃতি এক আশ্চর্য বস্তু, যা মুহূর্তের মধ‍্যে বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। হাতেগোনা কিছু মানুষের ভরসা চক্রাকার ডায়াল ঘোরানো গুরুভার ল্যান্ডলাইন টেলিফোন, যা দরকারের সময়ে প্রায়শই সঠিক নম্বরে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হতো, ও’ প্রান্তে সম্পূর্ণ অপরিচিতের প্রশ্নবাণের চোটে এ’ প্রান্তের লোক ব্যতিব্যস্ত অথবা কথা বলতে বলতে ক্রস কানেকশনের অযাচিত উপদ্রবে অতিষ্ঠ হওয়া ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

কলকাতার রাস্তাঘাটে তখন সরকারী বেসরকারী একতলা বাসের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রাম, দোতলা বাস, অ্যাম্বাসাডর, ফিয়াট/প্রিমিয়ার। জীবনযাত্রা আজকের তুলনায় অনেক সরল, তবে সমস‍্যাও যে একেবারে নেই তাও নয়। নকশাল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলেও মাথার ওপরে এমার্জেন্সীর কালো ছায়া, চতুর্দিকে নিয়ন্ত্রণের চোখরাঙানী। তবুও পাড়া কালচার, রকের আড্ডা, মোহন-ইস্ট দ্বন্দ্ব, বিকেলবেলা পাড়ার মাঠে ছেলেদের দাপাদাপি, সন্ধ‍্যেবেলা কোনোও বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে হারমোনিয়ামধ্বনির সঙ্গে ভেসে আসা কচি গলার তারস্বর, রেডিওতে বিবিধভারতীর অনুষ্ঠান, উত্তম-সুচিত্রা জনপ্রিয়তার মধ‍্যেই সৌমিত্র-অপর্ণা, শমিত-সোনালী বা রঞ্জিৎ-মিঠুর মাথাচাড়া দেওয়া, রাজেশ খান্নার রোমান্টিসিজমের পাশাপাশি রাগী অমিতাভের ক্রমউত্থান ―এইসব নিয়েই বাঙালীর জীবন দিব‍্যি কেটে যাচ্ছিলো। ফ্ল‍্যাট কালচার, বেসরকারী ইংরেজী মাধ‍্যম বিদ‍্যালয়ের অতিরিক্ত আগ্রাসন তখনোও হয়নি। বাঙালী তখন যৌথ পরিবারের অন্তর্বর্তী হয়ে বাংলাতেই কথা বলতেই বেশী ভালোবাসতো।

ঠিক এই সময়েই ঘটে গেলো এক ঘটনা। যুগান্তকারী নয় বরং বলা চলে এক যুগের সূত্রপাত। মহাত্মা গান্ধীর “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ৯ই আগস্ট তারিখটি নিতান্তই সৌরবর্ষী রীতি মেনে এই বছরের (২০২৫) মতোই ১৯৭৫ সালেও ছিলো, শনিবার। সেদিনই সন্ধ‍্যায় শ্রীমতী শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত ঘোষণা করলেন, কলকাতা দূরদর্শনের শুভসূচনা। জন্ম নিলো কলকাতার নিজস্ব টেলিভিশন, টিভি―ঘরে বসা কলকাতাবাসীকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার সেই প্রথম পদক্ষেপ।

তখনকার টেলিভিশন সেট আজকের মতো ছিলো না। বিশাল বড় অ্যান্টেনা সম্বলিত ছিলো সেই সময় টিভিসেট। কাঠের বাক্স বা ক‍্যাবিনেটের মধ‍্যে চৌকো স্ক্রীন, যাতে কেবলমাত্র সাদা-কালো ছবিই দেখা যেতো। চ‍্যানেল বলতে মাত্র একটিই। তাতেই দিনে মাত্র তিনঘন্টা বাংলা ভাষার সম্প্রচারিত কিছু অনুষ্ঠান। তাও কি শান্তিতে দেখবার জো আছে? পাখীর উপদ্রব বা জোর হাওয়ায় অ্যান্টেনা ঘুরে গেলে ছবি চলে যেতো, সেটাকে আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সঠিক পজিশনে আনতে হতো, কাছাকাছি ডিসি পাখা ঘুরলে ছবি স্ক্রোল করতে শুরু করে দিতো….অনেকে আবার স্ক্রীন থেকে প্রতিফলিত উজ্জ্বল আলোকছটা থেকে চোখ বাঁচাতে তার ওপর একটা নীলরঙের স্বচ্ছ কভার লাগাতেন, পরবর্তীকালে কেউ কেউ বহুবর্ণ কভারও লাগাতেন―বুঝুন, স্ক্রীনের একদিকে যে শিল্পীর জামার রং লাল, বাঁদিকে গেলে তাঁর সেই একই জামা হয়ে যাচ্ছে নীল বা সবুজ।

দূরদর্শনের প্রথমদিকের সম্প্রচার ছিলো নিতান্তই সীমিত গণ্ডীর মধ‍্যে, যদিও নাচ-গান-নাটক-সিনেমা, বিভিন্ন জানা-অজানার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি খেলাও দেখানো হতো। ১৯৭৭ সালে ইডেন গার্ডেন্স থেকে সরাসরি সম্প্রচার হলো, পেলের কসমস ক্লাবের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের প্রীতি ফুটবল ম‍্যাচ। এবং পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে কলকাতা দূরদর্শন তার দর্শকদের স্বাদ পাওয়ালো বিশ্বকাপ ফুটবলের। তারপর থেকে ফুটবল বিশ্বকাপ, ক্রিকেট, টেনিস, ব‍্যাডমিন্টন, এশিয়াড, অলিম্পিক―টিভির পর্দায় সবকিছুরই সাক্ষী হতে থাকলো কলকাতাবাসী। ১৯৮৩ সালে লর্ডসের মাঠে উপস্থিত না থেকেও টিভির পর্দায় ক্রিকেটে ভারতের বিশ্বজয় যে সকল ভারতবাসী প্রত‍্যক্ষ করেছিলেন, তাঁদের আনন্দ আজকের দিনে অনুমান করা বোধহয় সত্যিই সম্ভব নয়।

১৯৮২ সালের ১৫ই আগস্ট শুরু হলো, রঙীন সম্প্রচার এবং সেইসময় থেকেই আত্মপ্রকাশ করলো রঙীন টেলিভিশন এবং মূলতঃ তখন থেকেই শুরু হলো, বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা আয়োজিত বাংলা ধারাবাহিকের যুগ। ১৯৮৭/৮৮ সালে সেই সময়কার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান “দর্শকের দরবারে”, “হরেকরকম”, “চিচিং ফাঁক”, “চিত্রমালা”-কে একপ্রকার  ম্লান করে দিলো “তেরো পার্বণ”, “বিচিত্র তদন্ত”, “উড়নচণ্ডী” ধারাবাহিকগুলি…

সেই সময়ে বাংলা ধারাবাহিকগুলি সীমিত পর্বের হতো। টিআরপি শব্দটি তখনোও সকলের অজানা। ১৩, ২৬, ৩৯ পর্বের ধারাবাহিক। সপ্তাহে মাত্র একদিন। তাতেই তুমুল জনপ্রিয়তা। প্রিয় ধারাবাহিকের সম্প্রচারের দিনটির ওই বিশেষ সময়টিতে কেউই বাড়ির বাইরে থাকতে চাইতেন না। মিস হয়ে গেলে কপাল চাপড়ানো ছাড়া গতি নেই কারণ রিপীট টেলিকাস্ট বলে তখন কিছু ছিলো না। তার ওপরে ছিলো লোডশেডিংয়ের ভ্রূকুটি। বিদ‍্যুৎ সরবরাহের অভাবে দর্শকরা তাঁদের প্রিয় অনুষ্ঠান দেখা থেকে বঞ্চিত হতেন। ধারাবাহিক সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মনে থেকে যেতো তাদের রেশ। “সেই সময়”, “কলকাতা”, “এক সমুদ্র অনেক ঢেউ”, “গোরা”, “সুবর্ণলতা”, “আদর্শ হিন্দু হোটেল”, “সিদ্ধার্থ চ‍্যাটার্জীর অন্তর্ধান”, “নৃসিংহ রহস‍্য”, “মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি”, “অভিনন্দন ভগীরথ”, “গোয়েন্দা ভগবানদাস”, “গোগোল”, “আবার যখের ধন”, “বিবাহ অভিযান”….কতো নাম করবো? সেই সঙ্গেই ছিলো, দিল্লী থেকে সম্প্রচারিত হিন্দী অনুষ্ঠান। চিত্রহার, বুনিয়াদ, খানদান, হামলোগ, মালগুডি ডেজ ইত্যাদি এবং অতি অবশ্যই সেই দুই কালজয়ী ধারাবাহিক…রামানন্দ সাগরের “রামায়ণ” ও বি.আর.চোপরার “মহাভারত”―যা আপামর ভারতবাসীর স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। ১৯৮৮ সালের আর এক কালজয়ী অনুষ্ঠান, তুমহারা”…সকল ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ “মিলে সুর মেরা তুমহারা…” যাতে দেখা গেছিলো সেই সময়কার জনপ্রিয় ভারতীয় ব্যক্তিত্বদের অনেককেই।

নব্বই দশকে এলো মেট্রো চ‍্যানেল (ডিডি-২),  সেই সঙ্গেই সুপারহিট মুকাবিলা। তারপর এলো ডিডি-৭ (বর্তমানে যা ডিডি বাংলা) ―জন্ম নিলো সর্বক্ষণের বাংলা ভাষার চ‍্যানেল।

টেলিভিশন এককথায় মানুষকে ঘরবন্দী করে দিলো।বিশেষতঃ মহিলাদের। কারণ তখন বেশীরভাগ বিবাহিতা মহিলা ছিলেন মূলতঃ গৃহবধূ এবং সারাদিনের গৃহকর্মের শেষে সন্ধ‍্যেবেলা টিভির পর্দায় চোখ রেখে তাঁরা প্রিয় অনুষ্ঠানের স্বাদ নিতেন। কাজ সেরে রাত করে বাড়ি ফেরা পুরুষরা অনেক ক্ষেত্রেই হতেন বঞ্চিত। তবে অনেক দম্পতি রাত্রিবেলা ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে উপভোগ করতেন গভীর রাতের ইংরেজী “বড়দের” ছবি।

আজ টিভির সেই বিপুল কলেবর অন্তর্হিত, বর্তমান প্রযুক্তির কল‍্যাণে সে এখন তণ্বী এল.ই.ডি. বা ও.এল.ই.ডি.। অসংখ্য চ‍্যানেল, চব্বিশ ঘন্টাব‍্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান―যা টিভিতে নির্দিষ্ট সময়েও দেখা যায় আবার ওটিটির সৌজন্যে নিজের সুবিধামতো যে কোনোও সময়েই দেখে নেওয়া যায়, এমন কি মোবাইলেও।

পৃথিবী আধুনিকতার দিকে এগোবেই। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে আসছে, এটাই চিরকালীন রীতি। টেলিভিশন নিজেও আধুনিকতারই ফসল। কিন্তু আজকের আধুনিক বাংলা অনুষ্ঠান কি সেই সীমিত ক্ষমতার অনুষ্ঠানগুলির সমতুল্য? প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হলেও, গুণগত মানে কি তারা এগিয়ে? টি.আর.পি.র দোহাই দিয়ে অবান্তর অবাস্তব ঘটনাবলী প্রদর্শন করে (পড়তে হবে কাহানী মেঁ নয়া ট‍্যুইস্ট) বছরের পর বছর ধরে চলে ধারাবাহিকগুলি যখন শেষ হয় তখন স্বস্তির শ্বাস ফেলা ছাড়া গতি থাকে না। অল্পদিনের মধ্যেই সেগুলি স্মৃতি থেকে মুছেও যায়। পুরনো ধারাবাহিকগুলির ক্ষেত্রে কিন্তু এমন হতো না।

তবে, সংবাদ, খেলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নতি অনস্বীকার্য।

আরোও একটা কথা না বললেই নয়। সত্তর বা আশির দশকে টিভি বস্তুটি ছিলো মহার্ঘ‍্য। পাড়ায় মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের বাড়িতে টিভি থাকতো। তাঁদের বাড়িতে ভিড় জমাতেন বাকিরা। সাধ‍্যমতো আপ‍্যায়ণও চলতো। রবিবার সকালে একতলা বাড়িতে টিভি চললে রামায়ণ মহাভারতের মতো জনপ্রিয় ধারাবাহিকগুলির সময়ে জানলার বাইরে লোকের ভীড় লেগে যেতো। এখন এসব ভাবাই যায় না।

জীবন যতোই এগিয়ে যাক, জন্মমুহূর্ত সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের ৯ই আগস্ট ২০২৫ তাই শুধুই কলকাতা দূরদর্শনের ৫০ বছর পূর্তি নয়।

কলকাতাবাসীর বিশ্বদরবারে পৌঁছবারও অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হলো আজ।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. কিচ্ছু বলার নেই। সোজাসাপ্টা ভাষায় অসাধারণ প্রতিবেদন। সবার পড়া উচিৎ। 👌🏻👌🏻👌🏻

    1. আমি খুব ছোট থেকেই টিভি দেখছি। প্রায় সূচনালগ্ন থেকে বলা যায়। খুবই ছোট ছিলাম। ঐ সময়ে চিচিং ফাঁকে শ্রদ্ধেয়া মৈত্রী দেবী তাঁর ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করছেন। ছোটদের তাঁর ছোটবেলার গল্প শোনাচ্ছেন। আমি মৈত্রী দেবীর পাশে বসে তাঁর কাছে গল্প শুনছি এমন একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও করার সৌভাগ্য ও হয়েছিল।

      সেই প্রাচীন সময় থেকে কলকাতা দূরদর্শন দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সৃজিতের লেখায় দূরদর্শনের ৫০ বছরের যাত্রার কিচ্ছুই বাদ পড়েনি। খুব ভালো লাগলো পড়তে। নস্টালজিক অনুভূতি।

        1. দা্রুণ হয়েছে লেখাটা।সে সময় যারা টিভি দেখত,অর্থাৎ আজকের প্রবীন/প্রবীণা্রা
          তাদের নিশ্চিতরূপে তখনের পরিবেশিত অনুষ্ঠান গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।

    2. সুন্দর লেখনী। ভাসমান স্মৃতির সাম্পান। সে এক দিন ছিল বটে।

  2. খুব ভালো লেখা।ওই সময় কল্পবিজ্ঞানের উপরে একটা দারুণ ইংলিশ সিরিয়াল হতো।আমরা কয়েকজন মিলে একসাথে বসে দেখতাম। “জনি সাকো এন্ড হিজ ফ্লাইং রোবট”

    1. ওটা বাংলা নয়। আমি মূলতঃ বাংলা অনুষ্ঠানগুলোকেই তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি। হিন্দী যেগুলোর নাম আছে বা খেলার কথা সেগুলো শুধুই সময়টাকে বোঝাবার জন‍্যে। তার ঈঙ্গিতও প্রবন্ধে দেওয়া আছে। যেমন ১৯৭৮ বিশ্বকাপ ছিলো, কলকাতাবাসীর টিভির পর্দায় প্রথম বিশ্বকাপ ইত্যাদি।

  3. ১৯৭৫ সালে আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের স্কুলে একটা টেলিভিশন আনা হয়েছিল যাতে এলাকার লোকেরা কলিকতা টেলিভিশনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখতে পায়। আমি গেছিলাম দেখতে।

  4. অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন , খুব সুন্দর লিখেছেন .

Leave a Reply to Sumona Choudhury Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!