Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৩৬
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৩৬

গোপা মিত্র

ল্যান্সডাউন খিরসু পউরি
পর্ব-২

ঘনসন্নিবদ্ধ চারিপাশের গাছপালার মধ্যে দিয়ে বেশ এক ছায়াময় পথ ধরে, শীতের আমেজ গায়ে মেখে আমরা চলেছি মগ্ন হয়ে – হঠাৎই চোখে পড়ল পাশের এক গাছের ডাল থেকে ঝুলছে মসৃণ উজ্জ্বল নীল সিল্কের এক রিবণ, তাতে আবার সাদা দাগ দিয়ে ডিজাইন করা। রিবণ তো গাছের ডালে বাঁধাও নয়, তবে কোন্‌ মন্ত্রবলে আটকে রয়েছে ঐ গাছের ডালে? এমন নিরিবিলি নির্জনে খিরসুর জনশূন্য এমন এক প্রকৃতি উদ্যানে রিবনই বা ঝুলিয়ে রাখলো কে? ভালো করে লক্ষ্য করতেই চোখে পড়লো তাকে- গাছপালার আড়ালে লম্বা লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকা সুন্দর সেই, নীল বর্ণের পাখীর দিকে। এই পাখীই কি তবে ‘Red Billed Blue Magpie’ নাকি অন্য কোন নাম আছে এর, সেসব বলবে পক্ষীবিশারদেরা। আমি কোন নাম বিতর্কে যেতে চাই না, আমার যেন মনে হলো ছোটবেলায় বইয়ে পড়া সেই ল্যাজঝোলা পাখীটিকেই আমার সামনে দেখছি।

পউরি থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে ১৭০০ মিটার উচ্চতায় গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে ছোট্ট জনপদ খিরসু, স্বল্পখ্যাত আলস্যমাখা এক অন্যরকম শৈলগ্রাম। বরফিলা পাহাড়, সতেজ সবুজের পাহাড়ী ঢাল আর উপত্যকার বিভঙ্গে ঘুমিয়ে থাকা এক উত্তুরে গ্রাম। প্রশস্ত সবুজ লন আর রংবেরঙের মরসুমি ফুলের উদ্যান সংলগ্ন পাহাড়ের ধাপে গড়ে ওঠা GMVN-এর এই বাংলোটি যেন তৈরীই হয়েছে প্রকৃতির মাঝে তুষারশৃঙ্গরাজির সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য। লনের বিপরীতেই ১৮০ ডিগ্রী বিস্তারে অসাধারণ অপরূপ নৈসর্গিক বরফাবৃত হিমালয় শিখরমালা, যেন আমাদের অভ্যর্থনায় অপেক্ষমান। তুষার শিরস্ত্রাণ শোভিত দুগ্ধধবল পর্বত শিখরগুলি – নন্দাদেবী, নন্দাকোট, ত্রিশূল, চৌখাম্বা, পঞ্চচুল্লী সবই যেন নিষ্পলক চেয়ে আছে আমাদের দিকে। এখানে আসার আগে আমার তো কল্পনাতেও ছিল না যে, সর্বক্ষণই এরা আমাদের সঙ্গী হবে।

এবার বেরলাম পায়ে হেঁটে খিরসু দর্শনে, যদিও আমার মনে হচ্ছিল, যে রূপসুধা পানের জন্য এখানে আসা তা তো সর্বক্ষণই রয়েছে আমাদের চোখের সামনে তবে আর বেরবার দরকারই বা কি! তখন কি আর জানি খিরসুতে আমার জন্য রয়েছে আরো কি বিস্ময়!

বিকেল প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। লজ থেকে বার হয়ে বাঁ দিকের উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা চারজন। পথিপার্শ্বের শোভা বৃদ্ধি করে পাহাড়ের ধাপে ধাপে নেমে গেছে দেওদার, নীল পাইন ও আরো কত নাম না জানা গাছের গহীন গভীর সতেজ সবুজ অরণ্য। মাঝেমাঝেই তার মধ্যে থেকে উঁকি মারছে কোন বুনোফুল। শেষ বিকেলের সেই সময়ে, বনের যত গাছ, যত ঝোপ আর ঘাসজমি, সবই যেন তখন বাসায় ফেরা শত শত পাখীর কলতানে ঝুমঝুমির মত বেজে উঠছে। হঠাৎই থেমে যেতে হল। আর এগনো যাবে না। পথ মিশে গেছে সামনের অরণ্যে।

ফিরে চলেছি লজের দিকে। এমন সময় ওকি? হলুদ ডানায় ঝিলিক তুলে এক ঝাঁক ছোট্ট হলুদ পাখী হঠাৎই যেন হারিয়ে গেল পাশের গাছের ডালপালা আর পাতার আড়ালে। একসঙ্গে এত হলুদ পাখী আগে তো আমি দেখিনি! দেখতে অনেকটা ফিঞ্চের মত, কি জানি কি নাম ওদের! বুঝলাম এখানেই ওদের বাসা- সারাদিন পর ওরা এখন বাসা ফেরার তাড়ায়। ছবি তোলা গেল না। ঠিক করলাম পরদিন আগে থেকে এসে ওদের জন্য এখানে অপেক্ষা করব।

পরদিন অবশ্য সেখানে যাওয়ার দরকার হল না – সকালে দেখলাম লজের ওপরের বিদ্যুতের তারগুলোর একটার ওপরে, বসে আছে কয়েকজন, রোদে তাদের নরম হলুদ পালকগুলো আরো যেন ঝক্‌ঝক্‌ করছে। এরা সম্ভবতঃ Finch প্রজাতি, আমি জানি না, জানবেন সেই পক্ষীবিশারদরা। 

লজ থেকে একটু এগিয়ে নিচে ডান দিকে এক প্রকৃতি উ্দ্যান – যেন সংরক্ষিত, পাখীদের জন্যই, বলা যায়, পাখীদের অভয়ারণ্য। এই পক্ষীনিবাসে প্রবেশাধিকার আছে সবারই, কিন্তু পাখীদের বিরক্ত করার অধিকার নেই কারো। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় সমৃদ্ধ এই প্রকৃতি অঞ্চলে রয়েছে পর্যটকদের জন্য ছাঁউনি দেওয়া সিমেন্ট বাঁধানো বসার ব্যবস্থা, সঙ্গে বিনোদনের জন্য দোলনা। 

আলোছায়ার আলপনা আঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। হঠাৎই মাথার ওপর দিয়ে নীল রঙের ঢেউ তুলে লম্বা লেজ দিয়ে বাতাসে আলপনা এঁকে, উড়ে গেল একঝাঁক ল্যাজঝোলা পাখী। আমাদের একদম পায়ের কাছ দিয়ে চকিতেই দৌড়ে সরে গেল ছোট্ট এক পাখী। ওদিকে আবার আকাশছোঁওয়া গাছের ঘন ক্যানোপির ওপর দিয়ে তখনই হুস হুস শব্দ করে উড়ে গেল পাঁশুটে ডানার নাম না জানা কোন পাখীর ঝাঁক। 

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম আরো একটু, আর এবারেই গাছের আড়ালে নয়, চোখের সামনেই দেখলাম, নীল রঙের আলো ছড়িয়ে লম্বা লেজ মেলে দিয়ে এক থামের সামনে বসে আছে একলা এক ল্যাজঝোলা। কি আশ্চর্য! আমরা পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছি, ছবি তুলছি, তবুও তার সরে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। সে যেন নিশ্চিত জানে আমরা তাকে যেমন বিরক্ত করব না, তেমন ক্ষতিও করব না। স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকেই হয়ত তারা, এই পক্ষীকূল, এমন আশ্বাস পেয়েছে। এখানের বাসিন্দারা প্রকৃতিকে নষ্ট হতে দেয় নি, বরং প্রকৃতির মাঝে বেঁচে থাকা প্রাণীদের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এরা জানে পর্যটনই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, তাই পর্যটকদের স্বার্থেই প্রকৃতি রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব,কর্তব্য। আমরা যে কেন এদের মত নই!

হঠাৎই এক গাছের ওপর থেকে ভেসে এল ঠক্‌ঠক্‌ শব্দ। কি হল? ও কিসের শব্দ? সেই গাছের নিচে গিয়ে দেখি লাল কালোয় বর্ণময় এক পাহাড়ী কাঠঠোক্‌রা (Mountain Woodpecker) আপন মনে গাছ ঠুকরে চলেছে – কেন কে জানে! আমরা যে নিচে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করছি , সেদিকে তার নজরই নেই।

বেশ কিছুক্ষণ জনশূণ্য সেই প্রকৃতি অরণ্যে কাটিয়ে, দোলনায় দুলে, বিশ্রাম নিয়ে বা বলা যায় নিরিবিলি নির্জনে পাখীদের রাজত্বে তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। 

লজের দিকে না ফিরে এগিয়ে চললাম গ্রামের দিকে। মাত্র দু একটা মুদী দোকানের মত ছোট ছোট দোকান চোখে পড়ল। সেখানে মশলাপাতির সঙ্গে বিক্রী হচ্ছে মাত্র কয়েক রকমের বিস্কুট, চিপস্‌ এবং কিছু কোল্ড ড্রিংকস্‌। এদের গ্রাম আরো নিচে। তবে চোখে পড়ল পাহাড়ে ধাপ চাষ, আপেল বাগান আর রংবেরঙএর বুনো ফুল। 

ফিরে এলাম লজের কাছে। প্রবেশ পথের একটু আগেই এক জায়গায় জমে থাকা কিছু জঞ্জালের মধ্যে দেখলাম এক ঘুঘু (Oriental Turtle Dove) কিছু খুঁজে চলেছে, বোধহয় তার খাবার। দেখতে সাধারণ ঘুঘুর মত হলেও এদের চোখের তলার লম্বা গলায় যেন আঁকা রয়েছে পালকের আরো এক চোখ।

লনের উল্টোদিকে তখনও অপলক চেয়ে নীল আকাশের পটভূমিকায় তুষার শৃঙ্খলে বাঁধা রোদ ঝক্‌মকে হিমালয় শিখরগুলি। মাথার উপরের তারের একটায় তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত কতকগুলি কালচে পাখী, আর তাদের থেকে একটু দূরে একান্তে দুই কালচে পাখী নিজেদের সুখদুঃখের কথায় মত্ত, এরা সম্ভবতঃ কোন প্রজাতির Rofous Naped Tit (Black Breasted, or Dark Grey Tit)।

লজের লনের এক জায়গার জমা ময়লার মধ্যে তখন ঠোঁট ডুবিয়ে একঝাঁক ভয়ডরহীন ল্যাজঝোলা পাখী খুঁজে চলেছে তাদের খাবার – কীটপতঙ্গ নাকি অন্য কিছু।

বিকেলে লজ থেকেই দেখলাম সূর্যাস্তের সময় বরফ সাদা শৃঙ্গমালার রং বদল। লালচে হয়ে ওঠা শৃঙ্গগুলি হঠাৎই যেন ঢেকে গেল অন্ধকারে। সূর্য অস্ত গেল।

সন্ধ্যার অন্ধকারে কালো আকাশের বুকে সামনের অভ্রভেদী বরফাবৃত পাহাড়চূড়াগুলিতে তখন ঝরে পড়ছে চাঁদের স্বর্গীয় আলো। আর তার রংলাবণ্যে যেন দৃশ্য অদৃশ্য সম্ভব অসম্ভবের মাঝামাঝি অপরূপ এক রূপ ধরে ভেসে উঠেছে সেই শৃঙ্গমালা। পদতলে তার পড়ে থাকা বিস্তীর্ণ বনভূমি, সেও তখন হয়ে উঠেছে মায়াময়। 

পরদিন ছাদে উঠে আবারও দেখা হল চারিদিকের উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে তাদের, সেই তুষারাবৃত, শিখরগুলির সঙ্গে। নেমে এলাম নিচে। এবার ফিরতে হবে। উপরের তারে তখন বসে রয়েছে আকাশের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে একলা এক বিরহী পাখী (Old World Flycatcher?), হয়ত তার সঙ্গীর খোঁজে বা আমাদের বিদায় জানাতে।

গাড়ীতে ওঠার মুখেই দেখলাম দুটো কালচে বাদামী মাউন্টেন বুলবুল পুঁতির মত চোখ তুলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।

ফেরার পথে দেখলাম জল্পাদেবীর মন্দির – উত্তরাখন্ডের এক বিখ্যাত সিদ্ধপীঠ, সাতপুলি (কোটদ্বার) আর পউরির মাঝে অবস্থিত। সবুজ অরণ্য পাহাড়ের মাঝে নদীর একেবারে পাশেই, মনে হয় যেন নদীর মধ্যেই,  এই মন্দিরের দেবী উত্তরাখন্ডবাসীদের পরম আরাধ্যা। এদের বিশ্বা‌স, জাগ্রত এই দেবী সবার ইচ্ছা পূরণ করেন। মন্দির ছোট হলেও চারিপাশের প্রাকৃতিক শোভা অনবদ্য।

ফিরে চলেছি গন্ডীবদ্ধ শহুরে জীবনে, বুক ভরা নির্মল বাতাস, চোখ ভরা প্রকৃতি, হৃদয় ভরা হিমালয় আর নজর কাড়া পাখীদের ছবি নিয়ে। এসেছিলাম পাহাড় প্রকৃতির সাহচর্যে নিরিবিলি নির্জনে শান্ত সমাহিত কটা দিন কাটাব বলে, কিন্তু উপরি পাওনা এতরকম পাখীর সান্নিধ্য! এরপরে হয়ত কোনদিনও এসব পাখীদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না – সময়ের সঙ্গে এদের স্মৃতিও হয়ত ফিকে হয়ে যাবে, কিন্তু তবুও সেই ল্যাজঝোলা পাখী (Red Billed Blue Magpie?), যদি তার দেখা কোনদিন পাই, তাকে আমি ঠিক চিনে নেব। 

— ল্যান্সডাউন খিরসু পউরি পর্ব সমাপ্ত —
লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to গোপা মিত্র Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!