Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৩৫
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৩৫

গোপা মিত্র

ল্যান্সডাউন খিরসু পউরি
পর্ব-১

আমাদের লজটি ল্যান্সডাউনের সর্বোচ্চ View Point, Tip N Top এর একেবারেই কাছে। লজের সামনে অনেকখানি ফাঁকা জমি, তারপর তার সীমানা ঘিরে দেওয়া কোমর সমান উঁচু মোটা পাঁচিল। সেই পাঁচিলের পাশে আমি তখন প্রায় সমাহিত, শিবালিক পর্বতশ্রেণী বেষ্টিত ওক পাইনের শান্ত নির্জন অরণ্য প্রকৃতির মগ্ন সৌন্দর্যে, এমন সময় আমার চোখে পড়ল সামনেই ফুটে থাকা ঝোপালো লাল ফুলগুলোর দিকে। ফুলের গাছগুলো উঠেছে ঠিক পাঁচিলের ধারের বনভূমি থেকে। অবশ্য মাত্র দু চারটি গাছ। আরে! এই ফুলগুলোকে তো আমি চিনি – রডোডেনড্রন, এদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তো ভূটান ভ্রমণে গিয়ে। এদের কথা না হয় ভূটান ভ্রমণ পর্বেই বিস্তারিত বলব।

২০১৫ সালে এপ্রিলের প্রথমে, দিল্লীতে তখনও রয়ে গেছে শীতের রেশ, আমরা চারজন আমি, কল্যা‌ণ, আনু, সুনীত স্থির করলাম, যাবো কাছাকাছি কোন বরফাবৃত পাহাড় সান্নিধ্যে। তখনও বরফ গলার সময় হয়নি, কাজেই আমরাও নিশ্চয় বরফের দেখা পাবো। স্থির হল স্বল্পখ্যাত, যেহেতু ভীড় আমাদের একেবারেই নাপসন্দ, পাহাড়ী শৈলশহর খিরসু যাব, সঙ্গে ল্যান্সডাউন আর পথে পউরি হয়ে ফিরব।

সেইমতই ল্যান্সডাউন, খিরসুতে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের (GMVN) ট্যুরিষ্ট লজের বুকিং হয়ে গেল। সুনীতের গাড়ীতে ভোরবেলা আমরা রওনা দিলাম ল্যান্সডাউনের পথে। 

দিল্লী থেকে মাত্র ২৬০ কিলোমিটার ও দেরাদুন থেকে ১৫০ কিলোমিটার দুরত্বে উত্তরাখন্ডের পউরি গাড়োয়াল জেলায় ১,৭৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ল্যান্সডাউন, প্রকৃতির সাহচর্যে শান্ত নিরিবিলিতে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটানোর জন্য একেবারেই আদর্শ। দিল্লী থেকে গাড়ীতে গাজিয়াবাদ, মীরাট, খাটাউলি, বিজনোর, নাজিবাবাদ, কোটদ্বার হয়ে ল্যান্সডাউন পৌঁছতে সময় লাগে ৬/৭ ঘন্টা। কোটদ্বার পর্যন্ত প্রায় সমস্ত পথটাই সমতল হলেও পরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার চড়াই পথে পৌঁছতে হয় ল্যান্সডাউন। দিল্লীর কাছে হলেও ল্যান্সডাউন দিল্লীর একেবারেই বিপরীত – কোলাহলমুক্ত, নির্মল, সুন্দর। একদা ব্রিটিশ কলোনী, বর্তমানে গাড়োয়াল রাইফেলসে্‌র ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ল্যান্সডাউন – সুরক্ষিত, পরিচ্ছন্ন, তথাকথিত আধুনিকীকরণ থেকে দূরে এখনও Not So Developed। ছোট্ট এই শহরটি এককালীন ইন্ডিয়ার ভাইসরয় লর্ড ল্যান্সডাউনের নামাঙ্কিত। এখনও ব্রিটিশ স্থাপত্যের অনেক নির্দশন রয়ে গাছে এখানে।

ল্যান্সডাউন শহরের প্রাণকেন্দ্র (City Centre) থেকে Tip N Top Point-টি প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। সময় অল্প। তাই সামান্য আহারের পরই আমরা চললাম সেই Tip N Top Point-এ। পাহাড় সীমার এই অংশটি বাঁধানো, এবং তার উপর রঙ করা গাছের ডালের রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিং এর নিচ থেকেই নেমে যাওয়া অতল খাদ আবৃত গভীর অরণ্যে, দূরে তার প্রহরারত শিবালিক পর্বতশ্রেণী। এত উপর থেকে নিচের সমগ্র অরণ্যপ্রকৃতি আর সামনের বাধাবন্ধহীন দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী মিলে মনে হয় যেন তৈরী হয়েছে এক দৃশ্যছবি (Panoramic View)।

বেশ কিছুক্ষণ চারিপাশের দৃশ্যাবলী উপভোগ করে ঘনায়মান বিকেলে আমরা চললাম এক View Point-এ সূর্যাস্ত দর্শনে। পাহাড়সীমার একেবারেই ধারের এই Point-এর নিচ থেকেই নেমে যাওয়া বনভূমি্র ঠিক ওপারেই পাহাড়শ্রেণীর একেবারে মুখোমুখি তখন আমরা, মনে হচ্ছে এই অরণ্য পার হলেই পৌঁছে যাব ঐ পর্বত সমীপে।   

সূর্য তখন প্রায় অস্তে যেতে বসেছে। আমরা চেয়ে রয়েছি সেইদিকে — আমাদের চোখ আর সূর্য একই সরলরেখায় হলেও কিন্তু একেবারেই বিপরীতমুখী। শুরু হয়েছে রঙের খেলা লাল কমলা হলুদ – মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে আকাশের রঙ। আমাদের চোখের সামনে ঠিক উল্টোদিকেই তখন যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড। সেই আগুন আভাই যেন ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত আকাশময়। আমাদের চোখে এসে লাগছে তারই কম্পন নাকি সূর্যের তেজঃপুঞ্জ! বিকেলে বেরিয়েছি, সঙ্গে সানগ্লাস আনিনি। খালি চোখে আর সূর্যের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সেই আগুনের দীপ্তি না কি সূর্যের তেজ আমাদের চোখেও এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু এমন দুর্লভ দৃশ্য দেখার কৌতূহলে চোখ বন্ধ করতেও পারছি না।

পিছনে সরে এক গাছের আড়াল নিলাম, আর কোনক্রমে একচোখেও সেদিকে তাকিয়ে থাকতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎই যেন লাল সূর্য পিংপং বলের মত গড়িয়ে গেল পর্বত অন্তরালে। সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এল এক ছায়াময় অন্ধকার। এমন রাজকীয় সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য আর কি কখনো হবে আমার? ল্যান্সডাউন আমার মনে চিরকালীন হয়ে গেল এমন অবর্ণণীয়, বর্ণময়, অলৌকিক, সূর্যাস্ত দর্শনের জন্য।

ল্যান্সডাউনে রয়েছে একাধিক দ্রষ্টব্য – ওয়ার মেমোরিয়াল, গাড়োয়াল রাইফেলসের মিউজিয়াম, কালেশ্বর ও তারকেশ্বর মহাদেব মন্দির। তবে হিমালয়ের কোলে প্রকৃতির টানে আমরা অবশ্য এগুলোর কোনটাতেই গেলাম না – কারণ তখন আমাদের একটাই লক্ষ্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খিরসু পৌঁছে তুষারশৃঙ্গরাজি দর্শন। পথিমধ্যে একবার পউরিতেও নামতে হবে। 

সকালবেলা প্রাতঃরাশ পর্ব সেরে রওনা হলাম পউরি। ছোট্ট শৈলশহর পউরি গাড়োয়াল হিমালয়ের ১,৮১৪ মিটার উচ্চতায়, যেন কন্ডোলিয়া পাহাড়ের উত্তর কোলে ঝুলে রয়েছে। পউরি জেলা অবশ্য বড় অনেকটাই, তবে শৈলশহর খুবই ছোট – মাত্র কয়েক কিলোমিটার। ওক পাইন দেওদার ছাওয়া পউরি মূল শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে।

পাহাড়চূড়ায় কন্ডোলিয়া দেবমন্দির। নিচে সেই মন্দির সংলগ্ন কন্ডোলিয়া পার্ক। অনেকেই এখানে এসে পিকনিক করে। পার্ক থেকেই সিমেন্ট বাঁধানো ছাঁউনি দেওয়া সিঁড়ি উঠে গেছে মন্দিরে। চারিপাশের গাছপালার মধ্যে দিয়ে সেই খাড়া সিঁড়িপথ ধরে আমরা ছোট বড় অসংখ্য ঘন্টা ঝোলানো, মন্দিরের লাল বাঁধানো চত্বরে এসে পৌঁছে গেলাম। মনে হয় ঘন্টাগুলো মানতের ঘন্টা। আহা! উপরে উঠে চারিপাশে তাকিয়ে চোখ একেবারে জুড়িয়ে গেল। রেলিং ঘেরা প্রশস্ত মন্দির চত্বর যেন পাহাড় চূড়ায় এক নজর মিনার। শুনেছি এখান থেকে দেখা যায়, চারিপাশের সবুজ অরণ্য ভেদ করে মাথা তোলা বিস্তৃত হিমালয়ান রেঞ্জ। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের- মেঘাবৃত আকাশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন চারিপাশ আর টিপ্‌টিপ্‌ বৃষ্টির মধ্যে সে দৃশ্য আমাদের অধরাই রয়ে গেল। চত্বর প্রশস্ত হলেও, অর্ধগোলাকার মূল মন্দির খুবই ছোট। ছোট্ট এক দরজা দিয়ে নিচু হয়ে দেবদর্শন করে, ঝুলন্ত ঘন্টায় আওয়াজ তুলে আমরা ফিরে চললাম। শান্ত সমাহিত এমন জায়গাই মনে হয় দেবতাদের ধ্যানের উপযুক্ত।

এখান থেকে চললাম পউরি শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ৭,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম র‍্যান্সি ষ্টেডিয়াম। নানারকম খেলার সঙ্গে মাঝেমাঝেই এখানে বসে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলার আসর। চারিদিক ঘেরা বসার গ্যালারি সমেত ষ্টেডিয়াম যেন হঠাৎই পাহাড়চূড়া থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেখানে না পৌঁছলে বোঝাই যায় না যে এখানে এমন উঁচুতে রয়েছে এক স্টেডিয়াম। 

না, আর কিছু দেখা নয়, আর কোথাও থামা নয়। এবার সোজা খিরসু পৌঁছে হিমালয়ের সামনে বিরতি। 

— প্রথম পর্ব সমাপ্ত —
লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. পড়ে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল।
    খুব ভালো লেখা হয়েছে।‌‌

  2. ল‌্যন্সডাউনে আমাদের ভ্রমণের স্মৃতিমনে পড়লো। লেখা ভাল লাগল। আরো লেখা চাই।

    1. আমার লেখাটা যে পড়েছিস,এজন্য অনেক ধন্যবাদ ।

Leave a Reply to Srijit Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!