Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৬
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৬

গোপা মিত্র

এবার অরণ্যে – বান্ধবগড় ও কান্‌হা

।। দ্বিতীয় পর্ব ।।

চলেছি কান্‌হার পথে। সরে সরে যাচ্ছে গাছপালার সারি ও দু’পাশের গ্রামগুলি। এবার মধ্যদুপুরে মধ্যপ্রদেশের গরম বেশ ভালোই অনুভব করতে পারছি। বান্ধবগড়ের বনে যেটা মনেই হয়নি। কখন পৌঁছবো জানি না। এমন সময়ে গাড়ি থেমে গেলো। কিন্তু এ তো কোনোও অরণ্য নয়। চারিপাশ একেবারেই প্রায় বৃক্ষহীন ধূ ধূ। তবে কোথায় এলাম আমরা? জানলাম, আমরা এসেছি মান্ডালা জেলার জাতীয় ফসিল উদ্যানে (National Fossil Park)। এখানে প্রায় ৪০ থেকে ১৫০ কোটি বছর আগের উদ্ভিদগুলির গুঁড়ি রূপান্তরিত হয়েছে ফসিলে। দেখে মনে হচ্ছে এগুলি কোনোও উদ্ভিদ নয়, পাথর। বিভিন্ন আকৃতির, বিভিন্ন রঙের। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আমরা আবার এগিয়ে চললাম কান্‌হার পথে।

পূর্বে সাতপুরা আর পশ্চিমে বিন্ধ্য পর্বতের মাঝে মৈকাল পাহাড় জুড়ে প্রায় ২,০৫২ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ Well Maintained এই জঙ্গল। এর Core Area প্রায় ৯২০ বর্গ কিলোমিটার। Buffer Area ১,১৩২ বর্গ কিলোমিটার – বান্ধবগড়ের প্রায় দ্বিগুণ। Buffer Area-এ রয়েছে অনেকগুলি গ্রাম। জঙ্গল খোলা থাকে ১৫ই অক্টোবর থেকে জুন মাস পর্যন্ত। ১৮৯৪ সালে রুডইয়ার্ড কিপলিং এই জঙ্গল বিখ্যাত করে গেছেন তাঁর ‘The Jungle Book’ উপন্যাসের মাধ্যমে। তার সৃষ্ট ‘বাঘিরা, ‘বালু’, ‘শের খান’ – সবই এই জঙ্গলের প্রাণী। তাই এই জঙ্গল “কিপলিঙের জঙ্গল” নামেও পরিচিত। জব্বলপুর থেকে এর দুরত্ব ১৭৫ কিলোমিটার হলেও, বান্ধবগড় থেকে এর দূরত্ব আরোও বেশী। মাঝে আবার রাস্তায় একবার থেমেওছিলাম। তাই আমাদের পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেলো।

জঙ্গলের প্রবেশদ্বার দুটি। কিস্‌লি ও মুক্কি। আমাদের থাকার ব্যবস্থা কিস্‌লিতে – ‘বাঘিরা লগ হাট্‌স্‌’-এ। কোনোওরকমে তৈরী হয়ে আমরা এসে উপস্থিত হলাম ডাইনিং হলে, নৈশাহারের উদ্দেশ্যে। কটেজ থেকে বেশ কিছুটা বনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এই খাওয়ার ‘কুঁড়ে’। ম্যানেজার প্রথম দিনেই আমাদের সতর্ক করে দিলেন, আমরা যেন সকলে একসঙ্গে টর্চ জ্বেলে (কটেজগুলির সামনে আলো থাকা সত্ত্বেও), এখানে রাতের খাবার খেতে আসি। কারণ, রাতে মাঝে মাঝেই কটেজের সামনে বাঘ চলে আসে। সেইমতোই আমরা স্থির করে নিলাম যে, রাত আটটায় আমরা সকলে কটেজের সামনে একসঙ্গে হয়ে খেতে আসবো। রুটি, তরকারী, মুরগীর ঝোল আর ডেজার্ট দিয়ে রাতের আহার শেষে আমরা যে যার কটেজে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ভোরেই শুরু হবে আমাদের ‘কান্‌হা জঙ্গল সাফারি’। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি – অরণ্য ভ্রমণে সঙ্গে Mosquito Repelleant থাকলে ভালো হয়, যদিও কটেজের চারপাশ এতোই পরিষ্কার যে, মশা প্রায় নেই বললেই চলে। আর রাতেও ওরা আমাদের মশারি দিয়েছিলো।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো পাখীর কলকাকলিতে। বাইরে এসেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। চারিদিকে গাছপালার মাঝে এমনভাবে রয়েছে আমাদের কটেজগুলি, মনেই হচ্ছে না যে, কোথাও জঙ্গলের সৌন্দর্য ক্ষুন্ন হয়েছে। বরং মনে হচ্ছে, যেন একে অপরের পরিপূরক। অথচ কটেজের ভিতরে সেই সময়ের নিরিখে আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্যের কোনোও অভাব নেই। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয়, শীতল হাওয়ার পরশ নিয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে, আমরা সকলে উপস্থিত হলাম আমাদের জন্য তৈরী হুডখোলা মারুতি জিপসীর কাছে। দুটো জিপসী – একটা ধোঁয়াটে নীল আর একটা গাঢ় সবুজ। শুনলাম, কান্‌হার জঙ্গলে সবসময়ে একটা শীতের আমেজ জড়িয়ে থাকে। তাই সঙ্গে একটা হাল্কা চাদর থাকলে ভালো হয়।

আজ আমাদের জঙ্গল সফর জিপসীতে করে। শুনেছি কান্‌হার জঙ্গলে বাঘ তো দেখা যায়ই, তাছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ – চিতল, চৌশিঙা, সম্বর, নীলগাই – এছাড়াও বুনো শুয়োর, গাউর, ময়ূর, চিতা আর নানারকম বাঁদর আর প্রচুর পাখী নিয়ে কান্‌হার জঙ্গল জমজমাট। এই জঙ্গলে রয়েছে নানারকম সাপ ও সরীসৃপও। তবে, তাদের দেখা না পেলেই আমার পক্ষে ভালো হয়। কান্‌হার জঙ্গলের রত্ন বলা হয়, দুর্লভ প্রজাতির হরিণ বারাশিঙ্গাকে। একসময়ে এই প্রজাতির হরিণ প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিলো। একমাত্র কান্‌হাই তাদের সংরক্ষণ করে, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।

এগিয়ে চলেছে জিপসী। চারিপাশে গাছপালার ঘন সবুজ জঙ্গল। আর মাঝেমধ্যেই রয়েছে বিস্তৃত তৃণভূমি। Elephant Grass বা হাতিঘাসের মধ্যে অনায়াসেই লুকিয়ে থাকতে পারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার – কিপলিঙের ‘The Jungle Book’-এর চরিত্র ‘শের খান’। জঙ্গলে শাল ও বাঁশগাছের প্রাধান্য। আদিম এই অরণ্য, কোথাও গভীর আবার কোথাও ছোট ছোট ঘাসের কারণে ফাঁকা মনে হয়।

হঠাৎ দেখি জিপসীর সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে একদল মহিষাকৃতি প্রাণী। দেখতে মহিষ হলেও আকারে কিন্তু অনেক বড়। অবোধ চোখগুলি তুলে আমাদের যেন অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে তাদের রাজ্য দেখাতে। আরে ও কি! ওরা যে সব পায়ে সাদা মোজা পরে রয়েছে। তখনই জানলাম, এগুলি মহিষ নয় – ভারতীয় বাইসন বা গাউর। পায়ের সাদা লোমগুলো মোজার কথাই মনে করায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে তারা চলে গেলে, আমাদের জিপসীও এগিয়ে চললো।

এবার নজরে এলো দূরের এক জলাশয়ের ধারে ঘাসজমিতে চরে বেড়াচ্ছে ছোট বড় মিশিয়ে একপাল হরিণ। চিতল না কি চৌশিঙা – কারো শিং রয়েছে, কারো নেই। পুরুষ আর স্ত্রী হরিণের মধ্যে তফাৎ না কি বোঝা যায়, এই শিং দিয়েই। সোনালী চক্‌চকে শরীরে সাদা বুটি তাদের রূপ যেন বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে।

আরোও একটু এগোতে চোখে পড়লো – এই জঙ্গলের সম্পদ শাখাপ্রশাখা নিয়ে ১২ শিঙের বারাশিঙ্গা বা জলা হরিণ (Swamp Deer) – নিরীহ চোখদুটি তুলে দেখছে আমাদের। আহা! শিঙের কি বাহার! এই শিংই তো এই হরিণের বৈশিষ্ট্য।

এগিয়ে চলেছি আর এমনই নানা প্রজাতির হরিণই শুধুমাত্র দেখছি। কিন্তু এ বনের রাজা সেই ‘শের খান’ কই?

জঙ্গলের আর একটা নিয়মের কথা মনে হয় এখানে বলা আবশ্যক। গাড়ি বা হাতিতে সাফারির সময়ে লাগাতার একই দিকে তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় না, কোনখানে বাঘ জঙ্গলের রঙে মিশে আছে। যে কারণে, গাইড বা ড্রাইভার আঙুল তুলে দেখালেও, অনেক সময়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বারবার জঙ্গলের বিভিন্ন অংশে নজর ফেলতে হয় যাতে চোখ কোনোও একদিকে অভ্যস্ত হয়ে না যায় এবং বাঘ বা অন্য জন্তুর নড়াচড়াও ধরা পড়ে।

জঙ্গলে বাঘের হদিশ জানান দেয় বাঘের পায়ের ছাপ বা পাগমার্ক। এছাড়াও বাঁদরের এক রকম ত্রস্ত ডাক ও ব্যবহার জানান দেয় যে, কাছেই রয়েছে বাঘ। কারণ জঙ্গলে বাঁদরকে ভয় দেখানো বাঘ ছাড়া আর কার সাধ্যি? অবশ্য বাঁদরের ডাক বা ব্যবহার আমরা হয়তঃ বুঝবো না, তবে অভিজ্ঞ গাইড নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে।

হঠাৎ গাইড মুখে আঙুল দিয়ে আমাদের চুপ করতে বলে কি যেন শুনলো। জিপসী তখন থেমে গেছে। তারপর একদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। দেখলাম এক ঘাসজমির মধ্যে থেকে উঁকি মারছে একটা হলুদ মাথা।

‘শের খান’ – এ বনের রাজা!

কৌতূহলী দৃষ্টিতে সে তখন আমাদেরই দেখছে। উঠে বাইরে আসবার কোনোও লক্ষণই নেই। তার সেই অবস্থাতেই আমরা তার ছবি তুললাম। বাঘ তো দেখলাম – কিন্তু, এ কেমন দেখা? সম্পূর্ণ বাঘ তো পেলাম না ছবিতে।

সকালের ভ্রমণের শেষ করে ফিরে এলাম কটেজে। প্রাতঃরাশ প্রস্তুত। আজ রয়েছে পুরি-তরকারী। তৃপ্তি করে খেয়ে যে যার কটেজে ফিরে গেলাম। দুপুরের আহারের পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে এবারও আমরা চললাম বিকেলের ভ্রমণে – সেই জিপসীতে করেই। এবার বনে প্রবেশের পরেই দেখলাম সবুজের সঙ্গে রং মেলানো ঘাসের বনে হেঁটে বেড়াচ্ছে একলা এক ময়ূর। অলস চোখে একবার থেমে গিয়ে আমাদের দেখলো। ব্যাস্‌, তারপরেই আবার চলা শুরু। চারিদিকে শোনা যাছে পাখীর কূজন। কিন্তু তারা কোন গাছের আড়ালে যে রয়েছে, তা দেখার জন্য প্রথমে জিপসী থামাতে হবে। তারপর তাদের খুঁজতে হবে। তারপর তো তাদের ছবি তোলা। অসম্ভব! সে চেষ্টা আমরা কেউই করলাম না। তার মধ্যেই দেখলাম, উঁচু এক গাছের ডালে খোলা জায়গায় বসে আছে এক সার্পেন্ট ইগল না কি অন্য কোনোও পাখী – জানি না। বোধ হয় উঁচু ডালে বসে তার সঙ্গীকে; না কি খাদ্য খুঁজছে।

এবার কিন্তু আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এক সম্পূর্ণ ব্যাঘ্র দর্শন ও তার ছবি তোলা। বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, গাউর – এসবের পাশ দিয়ে জিপসী এগিয়ে চলেছে। কখনোও তাদের রাস্তা ছেড়ে দিতে থামছে, আবার এগিয়ে চলছে।

হঠাৎ যেন অরণ্য বড্ড বেশী নিস্তব্ধ। বাঁদরের ডাক। আমরা অবশ্য ডাকের অর্থ বুঝলাম না। গাইড মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললো। আমরা সবাই ক্যামেরা নিয়ে তৈরী। তারপর দেখলাম তাকে – রাজকীয় ভঙ্গীমায় গা এলিয়ে বসে রয়েছে ঘাসবনের বাইরে সামান্য ফাঁকা জায়গায়, যেন আমাদেরই অপেক্ষায়। সম্পূর্ণ বাঘের ছবি; যে যেমন পারলাম, ক্যামেরাবন্দী করলাম। সে একটুও নড়লো না। মনে হলো যেন সে এমন ছবি তোলাতে অভ্যস্ত।

রাতে সকলে একসঙ্গে খেতে চললাম খাওয়ার ঘরে। নিস্তব্ধ বনে ঝিঁ ঝিঁ ডাকের মধ্যে দিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যাওয়া কি যে রোমাঞ্চকর কি বলবো! রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনলাম বাইরে একটু দূর থেকে ভেসে আসছে বাঘের ডাক। কিন্তু বেরোবার প্রশ্ন নেই। তারপর একসময়ে থেমে গেলো সেই ডাক। পরদিন ভোরে তৈরী হয়ে বার হলাম। আজ হস্তিপৃষ্ঠে ভ্রমণ। শুনলাম গত রাতে কটেজের খুব কাছাকাছি বাঘ এসেছিলো। বাঘের পদচিহ্ন বা পাগমার্কও দেখতে পেলাম।

জিপসীতে চড়ে বনে প্রবেশ করবার পর ম্যানেজার আমাদের নিয়ে গেলেন এক বাঁধানো ছ-সাত ফুট উঁচু সিঁড়ির কাছে। হাতির পিঠে উঠে বসবার জন্যই এই সিঁড়ির ব্যবস্থা। দুটো হাতির পিঠে আমরা সবাই উঠে বসলাম। সেই পিঠোপিঠি বসা। সামনে এক মাহুত। জিপসী যেখানে যেতে পারে না, হাতি সেখানে যেতে পারে। বনের অলিগলিতে হাতির অবাধ স্বচ্ছন্দ বিচরণ – এটাই সুবিধে। ঘাসজমির উপর দিয়ে গাছপালা অগ্রাহ্য করে ঝরা শালপাতা মাড়িয়ে মচ্‌মচ্‌ আওয়াজ তুলে হাতি এগিয়ে চললো। এবারও বন থমথমে, নিস্তব্ধ। চারিপাশে কোনোও হরিণও দেখছি না। কি ব্যাপার? এমন কেন? তারপরেই আমাদের চোখের সামনে সেই দুর্লভ দৃশ্য। বাঘের শিকার ধরা। দেখলাম এক লেঙ্গুর, না কি হনুমান, গাছের ডালে উঠে বোধ হয় পালাতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু বিদ্যূৎগতিতে তার সামনের দীর্ঘ ঘাসের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলো এক বাঘ। লাফিয়ে উঠে চোখের নিমেষে তার টুঁটি কামড়ে ধরলো। ব্যাস্‌, সব শেষ! আমরা যখন ঘাসের ঝোপে ব্যাঘ্রপ্রবরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, শিকারী তখন একমনে তার লক্ষ্য স্থির করছে। তারপরেই সেই বাঘ তাকে ভক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমরা সবাই দূরে হাতির পিঠে বসে সবই দেখছি। তার খাওয়া শেষ হলে অর্ধভুক্ত শিকার সেখানেই ফেলে রেখে সে ঢুকে গেলো পাশের ঘাসবনে। এবার সে বিশ্রাম নেবে। আবার ক্ষিধে পেলে সে এখানেই এসে বাকিটুকু শেষ করবে। তাকে আর একটু সময় দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম বনের আরোও গভীরে।

আবারও দেখতে পেলাম বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ – চিতল, চৌশিঙা, সম্বর ইত্যাদি। এছাড়াও বারাসিঙ্গা, নীলগাই, বাইসন – এইসব তো আছেই। তবে এখানে কোনোও বন্য বরাহ, চিতা বা ভাল্লুক দেখলাম না।

আমাদের অরণ্য ভ্রমণ প্রায় শেষের পথে। আজ আর কোথাও যাওয়ার নেই। আমরা কটেজের আশেপাশে গাছপালার মধ্যপথ দিয়ে এদিক সেদিক বেড়াতে লাগলাম। গাছের ওপর দেখলাম, বাঁদর আর হনুমান তাদের সংসার সাজিয়ে বসেছে। কেউ তাদের বাচ্চাকে আদর করছে, কেউ বা উকুন বাছছে – কয়েকজন আবার একগাছ থেকে অন্যগাছে লাফিয়ে ট্রাপিজের খেলা দেখাচ্ছে। আমাদের প্রতি তাদের মনোযোগ নেই। আমরাও তাদের বিরক্ত করলাম না, শুধু দেখেই গেলাম তাদের কীর্তিকলাপ। ইচ্ছে হলেও ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলবার সাহস হলো না। যদি তারা অতি উৎসাহী হয়ে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়।

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের পরে আমরা আমাদের ‘অলউইন নিশান’ ওমনিবাসে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৫ : বান্ধবগড় পর্ব দ্রষ্টব্য) চড়েই রওনা দিলাম জব্বলপুরের পথে। সঙ্গে চললেন আমাদের ম্যানেজার। দ্বিপ্রাহরিক আহার সেখানেই। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ‘হোটেল কলচুরি’-তে। জব্বলপুরের ধুঁয়াদার ফলস্‌ আর মার্বেল রক্‌স্‌ দেখে পরশু আমরা পাঁচমারি-খাজুরাহোর উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। তবে সে অরণ্যপর্ব নয়, তাই অন্য কোনোও দিন বলা যাবে।

এই অরণ্যভ্রমণ প্রসঙ্গে M. P. Tourism-এর প্রশংসা করতেই হবে। যে সব জায়গায় তারা আমাদের রেখেছিলো বা যেভাবে আতিথেয়তা করেছিলো, তা এককথায় অতুলনীয়। আমি এই অরণ্যভ্রমণ কোনোওদিনও ভুলতে পারবো না। আর সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ বারবার অরণ্য সফরেও অনেক সময়ে বাঘের দর্শন পায় না। কিন্তু আমরা মাত্র একবার অরণ্য ভ্রমণে এসেই, এক নয়, একাধিক বাঘের দর্শন পেয়েছি। হয়তঃ ভাল্লুক বা নেকড়ে দেখতে পাইনি – কিন্তু এই বনের রাজার দর্শন পাওয়ার পর, তাদের না দেখলেই বা ক্ষতি কি? আমাদের এই অরণ্যসফর সফল শুধু নয়, সার্থকও বটে।

পরিশেষে শুধু একটাই কথা – কিপলিঙের ‘The Jungle Book’-এ ‘শের খান’ ছিলো এক হিংস্রকুটিল, অত্যাচারী বাঘ। কিন্তু আমার মনে হয় এই জঙ্গলের ‘শের খান’-রা অত্যন্ত ভালো। তাদের ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ বলা চলে। তারা আমাদের আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে এবং দেখা দিয়ে আমাদের সামনে ‘পোজ’ দিয়ে ইচ্ছেমতো তাদের ছবিও তুলতে দিয়েছে। আসলে আমরা তাদের বিরক্ত করিনি বলে, তারাও আমাদের শান্তভাবেই গ্রহণ করেছে।

— বান্ধবগড়-কান্‌হা পর্ব সমাপ্ত —

 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব ভালো লাগলো। এমন লেখা ছাপা র অক্ষরে ব ই বা ম্যাগাজিনে স্থান পেতে পারে।

    1. মুস্কিল হলো যোগাযোগ এর রাস্তা জানা নেই ।

  2. মুস্কিল হলো ,যোগাযোগ এর রাস্তা টা জানা নেই ।

  3. “Call of the wild”. চমৎকার লেখা। পড়ে ভালো লাগলো। প্রত‍্যেকটি ছবি দেখার মতো। চরৈবেতি।। 💐💐💐💐💐💐

    1. হ্যাঁ । পুরনো ভালো লাগার অনন্য এক স্মৃতি ।

  4. অসাধারণ সব experience হয়েছে তোমাদের।এইসব experience তুমি তুলে ধরেছো খুব সুন্দর ভাবে তোমার দারুণ লেখার মাধ্যমে।👌👏

  5. প্রাঞ্জল ভাষায় সাবলীল বর্ণনা লেখার সঙ্গে সমান্তরালভাবে পাঠকমনকে ভ্রমণ করতে লালায়িত করে, ঘরকুনোকেও করে তোলে ভ্রমণপিপাসু। আন্তরিক অভিনন্দন জানাই লেখিকাকে।

  6. প্রাঞ্জল ভাষায় সাবলীল বর্ণনা লেখার সঙ্গে সমান্তরালভাবে পাঠকমনকে ভ্রমণ করতে লালায়িত করে, ঘরকুনোকেও করে তোলে ভ্রমণপিপাসু। আন্তরিক অভিনন্দন জানাই লেখিকাকে। অনেক শুভেচ্ছা রইল।

    1. পাঠকের ভালো লাগলেই লেখিকার লেখা সার্থক । এই ভালো লাগাই আমায় আরো ভালো লিখতে অনুপ্রাণিত করবে । ধন্যবাদ ।

Leave a Reply to Anjana datta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!