গোপা মিত্র
অন্ধ বিচার
রহস্য ধারাবাহিক (শেষ পর্ব)
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কোর্ট চত্বর জনমানবশূন্য। শুধু প্রবেশ দ্বারে দুজন পুলিশ কর্মচারী অপেক্ষারত, অনুপমার জন্য। গাড়ী থেকে নামলেন বেদবাবু, অনুপমাকে নিয়ে। একজন পুলিশ বেদবাবুকে একটা বেঞ্চি দেখিয়ে সেখানেই তাকে বসতে বলল, আর একজন অনুপমাকে নিয়ে কোর্টের ভিতরে প্রবেশ করল।
ভিতরে কোর্টরুম সংলগ্ন একটা ছোট্ট ঘরে সে অনুপমাকে নিয়ে উপস্থিত হলো। নানারকম হাবিজাবি জিনিষ ভর্তি সেই ঘরের একটা ফাঁকা অংশে একটা টেবিলের দুধারে দুটো চেয়ার পাতা রয়েছে। পেশকার সেখানে কি যেন করছে। অনুপমাকে দেখে এগিয়ে এসে সে তাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল যে, দেখুন আপনার চাহিদা মত সব জিনিষপত্রই এখানে রাখা আছে। আপনি একবার দেখে নিন, আর কিছু দরকার আছে কি না! এই কথা বলে টেবিলের ওপরের জিনিষগুলোর ওপর অনুপমার হাত রাখল। মাটি ছাড়াও সেখানে মূর্তি গড়ার আরো কিছু আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি রয়েছে। অনুপমা সবকিছু বুঝে নিয়ে ঘাড় নেড়ে না জানালে, পেশকার ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে তাকে বলল যে, এক্ষুনি আপনার মডেল এসে যাবে, তারপর আপনি আপনার কাজ শুরু করে দেবেন। শুধুমাত্র আজ রাতটুকুই আপনার সময়, তার মধ্যেই আপনার কাজ শেষ করতে হবে। আমি ঘরের বাইরেই রইলাম, আপনার হয়ে গেলে আমাকে ডাকলেই আমি চলে আসব। ভয়ের কিছু নেই, আপনার নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশও বাইরেই রইলো।
বলতে বলতেই মডেল ভিতরে চলে এসে, তার উল্টো দিকের চেয়ারে বসে পড়েছে। পেশকার তার মুখের ওপর অনুপমার হাতটা ছুঁইয়ে রেখে দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলো। অনুপমা তার স্পর্শ আর অনুভব দিয়ে মডেলের মুখের গঠন বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলো। মাত্র সাত মিনিট সময়। তার মধ্যেই অনুপমাকে মডেলের মুখের গড়ন বুঝে নিতে হবে। মডেল কিন্তু সমানে নানা কথার জালে অনুপমাকে উত্ত্বক্ত্য করতে লাগলো। কখনো তার জন্মবৃত্তান্ত, কখনো তার ধর্ষণ নিয়ে নানা কুরুচিকর মন্তব্য করে তার একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটাতে চেষ্টা করতে লাগলো। । অনুপমা দু একবার বারণ করা সত্ত্বেও সে তার বলা থামাল না।
মাত্র সাত মিনিট সময়- অচিরেই শেষ হয়ে গেলো। ঘড়ি দেখে, মডেল উঠে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
নিরিবিলি নির্জনতায় একলা ঘরে অনুপমা জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা দিতে লাগলো।
রাত তখন কত অনুপমার জানা নেই, সে ডাক দিল পেশকারকে। সে এসে যত্ন করে মূর্তি উঠিয়ে নিয়ে গেলো। পুলিশ অনুপমাকে তার বাবার কাছে পৌঁছে দিল।
পরদিন সকাল। আজ কোর্টের রায় ঘোষণা। সকাল থেকেই কোর্ট চত্বরে জনারণ্য, তাদের মধ্যে মিডিয়া পার্সনরাও রয়েছে। প্রার্থণা সবার একটাই, অসহায় মেয়েটি ন্যায় বিচার পাক্, অপরাধীর শাস্তি হোক্।
নির্দিষ্ট সময়ে কোর্টের কাজ শুরু হলো। বেদবাবু তার মেয়ে অনুপমা ও তার স্ত্রী রুমাদেবীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আজও অনুপমার মুখে ওড়না জড়ানো। অজেয় রায় সুমেধা আর শরণ্যাকে নিয়ে এসে গেলেন, কে.কে. এলেন, তার জুনিয়ার, তার ছেলেকে নিয়ে। তদন্তকারী অফিসার হিসেবে অমলিন বসুও আজ কোর্টে উপস্থিত। এছাড়াও আজ কোর্টরুমের ভিতরে জুনিয়র উকিলদের ভীড়। কোর্টের ভিতরে বাইরে সকলেই উদ্গ্রীব রায় জানার অপেক্ষায়।
জজ্সাহেব এসে তার আসন গ্রহণ করলেন। তার সামনেই রয়েছে গতরাতে অনুপমার গড়া সেই মূর্ত্তিটি। তবে মুখটি একটি কাপড় দিয়ে ঢাকা। কোর্টের কাজ শুরু হলো। জজ্সাহেব উভয় পক্ষের উকিলের দিকে একবার দেখে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, রায় দানের আগে আপনাদের কি কিছু বলার আছে। অজেয় রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে, তার কিছু বলার আছে। হুজুর অনুমতি দিলে তিনি কিছু বলতে চান। “বেশ, বলুন”, জজ্সাহেব হাত দেখালেন।
অজেয় রায় শুরু করলেন “এটা একটা অদ্ভূত মামলা। একজন অন্ধ মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। ধর্ষণকারীকে সে দেখেনি, তবুও সে তার আশ্চর্য ক্ষমতাবলে তার মুখাবয়বের একটা মূর্তি গড়ে ফেলেছে। মুর্তির মালিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং বিচারের জন্য কোর্টে উপস্থিত করেছে। এতদিন পর্যন্ত বিচার চলাকালীন আমরা অনেক সাক্ষীর বয়ান যেমন শুনেছি, তেমন অনেক ভিডিও ফুটেজও দেখেছি। এই সবকিছু দেখে আর শুনে আমার যা মনে হয়েছে আমি এখন সেটাই বলতে চাই।
অভিযুক্ত রীতিন আগরওয়াল, অপরাধের আগের দিন এসেছিল বেদবাবুদের বাড়ীতে, তার এক বন্ধুর বাড়ীর ঠিকানা জানতে। সে সময়ই বেদবাবুদের কথাবার্তায় সে জানতে পেরে যায় পরদিন তারা কেউ বাড়িতে থাকবে না, এমনকি তাদের পরিচারিকাও সাড়ে দশটার সময় ব্যাঙ্কে যাবে, শুধুমাত্র অন্ধ মেয়েটি একলা বাড়ি থাকবে। সেসময়ই সে এই অন্ধ মেয়েটিকে দেখে এবং তাকে ধর্ষণের একটা প্ল্যান মনে মনে স্থির করে নেয়।
পরদিন বন্ধুদের সঙ্গে দীঘার এক রির্সটে তার পার্টী করার কথা ছিল, এর জন্য রির্সট বুকিংও করা হয়ে গিয়েছিল। সে কি করল, বন্ধুদের জানিয়ে দিল, তার একটা কাজ পড়ে যাওয়ার জন্য সে কাল সাড়ে এগারোটায় রির্সটে পৌঁছতে পারছে না, তার যেতে হয়ত দুপুর গড়িয়ে যাবে, বন্ধুরা যেন তার জন্য অপেক্ষা করে।
ঘটনার দিন সকালে সে তার নিউ আলিপুরের বাড়ী থেকে তার ড্রাইভারকে দিয়ে তার গোল্ডেন ইয়েলো গাড়িটি দীঘার উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিল, তবে একটা চালাকি করে। সে তার মোবাইলটি গাড়ীতেই রেখে দিল, যদি সে ধরা পড়েও যায় তবে তার মোবাইল ট্র্যাক করলে দীঘার রাস্তার টাওয়ার দেখাবে অর্থাৎ সে তার একটা অ্যালিবাই তৈরী করে রাখলো। এই কারণেই তার মোবাইল ট্র্যাক করে দীঘার রাস্তা দেখিয়েছে। ড্রাইভারকে সে নির্দেশ দিল, সে রির্সট পর্যন্ত যাবে ঠিকই, কিন্তু রির্সটে না গিয়ে, কাছেই তার বাড়ী কন্টাই বা কাঁথিতে চলে গিয়ে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করবে।
ড্রাইভারকে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো, তারপর একটা গাড়ী ভাড়া করে সে বেদবাবুর বাড়ীর কাছে উপস্থিত হয়ে গাড়ী ছেড়ে দিলো। এবার বাড়ীর গেট টপকে সে ভিতরে ঢুকে, পিছনের ঘরের কার্ণিশ দিয়ে দোতলার খোলা গ্রীলের জানলা দিয়ে ষ্টুডীওয় পৌঁছলো। তারপর আর কি? সিঁড়ির দরজা খোলা পেয়ে একতলায় নেমে এলো। আর ঠিক সেইদিনই তাড়াহুড়ো্র মধ্যে বেদবাবু দোতলার গ্রীলের জানলা বা সিঁড়ির দরজা বন্ধ করতে ভুলে চলে গেলেন।
মেয়েটির ওপর অত্যাচার করে সে ঐ একই পথে বাইরে বেরিয়ে গেলো। কেউ জানতেও পারলো না। তারপর আর একটা গাড়ী ভাড়া করে দীঘা রওনা হল। কিন্তু প্রথমেই সে রির্সটে না গিয়ে ড্রাইভারের বাড়ী পৌঁছল, সেখান থেকে নিজের মোবাইল নিয়ে ড্রাইভার সমেত সে গোল্ডেন ইয়েলো গাড়ী করে রির্সটে বন্ধুদের কাছে পৌঁছে গেল। বন্ধুদের সে শিখিয়ে রেখেছিলো, তারা যেন তার রির্সটে আসার সময় সাড়ে এগারোটা বলে। সেই মতই তারা একবাক্যে তাদের শেখানো বুলি সাড়ে এগারোটা আওড়ে গেলেও, সেই সময়ে অভিযুক্ত না আসায় তার পোশাক বলতে ভুল করে ফেললো। এই মামলায় একটি তথ্য বলা খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, আমি তদন্তকারী অফিসারকে অভিযুক্তের অতীত সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। তিনি আমায় জানিয়েছেন যে, বছর দু’য়েক আগে অভিযুক্ত রীতিন আগরওয়াল মুম্বইতে এমনই একটি ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলো এবং সেই সময়ে অর্থের জোরে সব কিছু ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছিলো। যাই হোক্, আমার বলা শেষ হয়েছে। এবার যদি বিবাদী পক্ষের উকিল কিছু বলতে চান!”
এই কথা বলে তিনি বসে পড়লেন।
জজ্সাহেব চাইলেন তার দিকে। তিনি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন “এতক্ষণ পর্যন্ত বেশ চমৎকার একটা মনগড়া গল্প আমরা শুনলাম, যার কোনো সারবত্তা আছে বলে আমার মনে হলো না। কিছু ভিডিও ফুটেজ আর কিছু সাক্ষীদের বয়ান, তার ওপর ভিত্তি করে আমার বিপক্ষের উকিল বেশ চমৎকার একটা গল্প বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আদালত গল্প শোনে না, প্রমাণ দেখে, প্রমাণ চায়। অভিযুক্তের অপরাধ এখনও প্রমাণিত হয়নি, মেয়েটি তার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ কিন্তু এখনও দিতে পারে নি। কাজেই আমরা অভিযুক্তকে এখনও দোষী বলে মানতে পারছি না”। এই বলে সে বসে পড়লো।
এবার জজ্সাহেব ফিরলেন গত রাতে মেয়েটির গড়া সেই মূর্তির দিকে। পেশকারকে বললেন, মুখের কাপড়টা সরিয়ে তার দিকে মুখটা ঘুরিয়ে দিতে। মুর্তিটি দেখে মুচকি হেসে জজ্সাহেব কে.কে.-কে তার কাছে ডেকে নিলেন। তারপর পেশকারকে বললেন মূর্তিটি সবার দিকে ঘুরিয়ে দিতে। পেশকার তাই করলো। কোর্টে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে দেখল, মূর্তির মুখটি হুবহু কে.কে.-র মুখের প্রতিচ্ছবি। হ্যাঁ, গতরাতে অনুপমার মডেল হয়েছিলেন স্বয়ং কে.কে. এবং বারবার তিনি অনুপমাকে ডিষ্টার্ব করে গিয়েছিলেন, যাতে সে ঠিক ভাবে মুর্তিটা গড়তে না পারে! তবুও শেষরক্ষা হলো না। অনুপমা তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দিল।
জজ্সাহেব রীতিন আগরওয়ালকে দোষী সাব্যাস্ত করলেন ও তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করলেন।
অজেয় রায় অনুপমার দিকে এগিয়ে এলেন, “তোমাকে আমি কথা দিয়েছিলাম ন্যায় বিচার পাইয়ে দেব। দিয়েছি তো? এখন তুমি নিশ্চয় খুশী। তুমি একজন সাহসী শুধু নয় বুদ্ধিমতী মেয়েও বটে! তোমার মনের জোরও প্রশংসনীয়। তোমার সামনে পড়ে রয়েছে দীর্ঘ পথ, এখন আর পিছন পানে না তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাও”।
অজেয় রায় বেরিয়ে এলেন সঙ্গে সুমেধা আর শরণ্যাকে নিয়ে। এগিয়ে এলেন কে.কে., অভিনন্দন জানালেন তাকে। পেশাদার উকিল তিনি, এটা তার ভদ্রতা। অজেয় রায় হাসিমুখে তা গ্রহণ করলেন। অনেকদিন আগে হওয়া তার সঙ্গে এক অন্যায়ের এইভাবেই মধুর প্রতিশোধ নিলেন তিনি।
অনুপমা এবার বেরিয়ে এলো তার বাবা মা আর অমলিন বসুর সঙ্গে। এখন তার মুখের আবরণ সরানো, দৃপ্ত ভঙ্গীতে সে জনতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন হলেও আজ সে তার লড়াইয়ে জয়ী। কারো করুণা তার চাই না। নিজের লড়াই সে নিজেই লড়তে পারে। দু’ পাশের জনতা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে হাততালি দিতে লাগলো। কিন্তু উপস্থিত একজন ক্যামেরাম্যানও তার ছবি তুলে তাকে জনসমক্ষে এনে তাকে বিব্রত করতে চাইলো না, যাতে সে ভবিষ্যত জীবনে কোনো রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়।
শেষ টা বেশ interesting হয়েছে।খুবই unexpected ending.দারুণ লেগেছে।লেখা চালিয়ে যাও।
অনেক ধন্যবাদ ।