Home গল্প, রহস্য ও ভৌতিক কবরখানার ঘর (পর্ব-১)
রহস্য ও ভৌতিকগল্প

কবরখানার ঘর (পর্ব-১)

শ্রাবণী চ্যাটার্জি

(এই কাহিনীর সকল চরিত্র, স্থান, কাল এবং বিষয়বস্তু কাল্পনিক, বাস্তবের সঙ্গে ঘটনার কোনও যোগসূত্র নেই। যদি কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তি অথবা ঘটনার সঙ্গে কাহিনীর কোনও মিল পাওয়া যায়, তা নিতান্তই কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত বলে ধরে নিতে হবে।)

গা ছম ছম করা ভৌতিক গল্প বা কোনও অলৌকিক ঘটনা পড়তে বা শুনতে অনেকেই ভালোবাসে। তবে আদতে অনেকেই ভুত, অশরীরী বা অপদেবতার কোনও অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করে না। আমিও এসব বিশ্বাস করিনা। কিন্তু আমি নিজে এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী যার কোনও ব্যাখ্যা আজও যেমন খুঁজে পাইনি, তেমনই সেই ছোট বেলায় ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনা আমি আজও ভুলতেও পারিনি।

দিনকয়েক আগে দাদার বাড়ি যাবো বলে শিয়ালদহ থেকে বারুইপুর লোকাল ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। ফাঁকা ট্রেনে জানলার ধরে সিট নিয়ে বসে পড়লাম। ট্রেন ছাড়তে প্রায় আধঘন্টা সময় লাগবে। প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখছি একে একে প্যাসেঞ্জাররা উঠছে, এসে বসছে। হকাররা নামা-ওঠা করছে।

জানলার ধারে বসলে সমস্যাও হয় অনেক সময়। জনে জনে এসে জিজ্ঞাসা করে যায়, এটা কোন ট্রেন? কখন ছাড়বে? একেক সময় বিরক্তও লাগে বৈকি! তবুও একটু হাওয়া পাওয়ার জন্য জানলার ধারটাই আমার পছন্দ। তাছাড়া, দীর্ঘদিন লোকাল ট্রেনে আসা-যাওয়ায় অনভস্ত আমি ট্রেনের ভেতরের ভীড়টাকে এড়ানোর জন্যে আগের লক্ষ্মীকান্তপুর ট্রেনটা ছেড়ে দিয়ে এই বারুইপুর লোকালটায় উঠে বসেছি। এটাতে ভীড় কিছুটা কম হয় অন্য লোকাল ট্রেনের তুলনায়। প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে আনমনে যাত্রীদের আসা-যাওয়া লক্ষ্য করছি। সেই ছোটবেলার মতো এখনও চলন্ত গাড়ি থেকে বাইরের ছুটে চলা গাছপালা, ঘরবাড়ি, মাঠপথ, ধানজমি, সবকিছুই আমাকে ভীষন টানে।

শ্যামলা-স্লিম, চোখে গগল্স এক মহিলা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, এটা কি বারুইপুর লোকাল? আমি হ্যাঁ বলতেই খোলা চুল, পয়েন্ট হিল পরা মহিলা ট্রেনে উঠে এসে উল্টোদিকে ঠিক আমার সামনেই বসলেন। ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে মিনিট দু’য়েক কারুর সঙ্গে কথাও বলে নিলেন।

আমার পাশের সিটগুলো তখনও ফাঁকা পড়ে আছে। সারা কম্পার্টমেন্টে খাপছাড়া কিছু কিছু লোক বসে আছে। তারমধ্যেই আমি এক ঝলক তাকিয়ে মুখের গড়ন আর কথা বলার ধরণ দেখে, তাকে আমার ভীষণ চেনা চেনা লাগলো। মনে হলো যেন ভদ্রমহিলা আমার অনেক দিনের পরিচিত!

 নামটা মনে আসতেই কোনও দ্বিধা না করে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, তু..তুই শম্পা না…!

সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে থেকে তারপর বললো, “হ্যাঁ, আমি শম্পা।”

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম,কিন্তু কোনও সুযোগ না দিয়ে সেও বলে উঠলো, “আরেঃ তুই! ওঃ! সরি, সরি! আমি প্রথমে তোকে চিনতে পারিনি রে! এবার চিনেছি!”

ততক্ষণে সামনে থেকে উঠে এসে পাশে বসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর একেবারে উচ্ছল গলায় বলে উঠলো উফঃ, এতো বছর পর এভাবে দেখা হবে ভাবিনি!!

এ কথা সে কথা দিয়ে গল্প শুরু হলো। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। অল্প সময় হাতে, আর এতো বছরের কত জমা কথা শুরু হতে হতেই শেষ করতে হলো।

শম্পা বললো, চাকরিসূত্রে ও ফ্রান্সে থাকে। দো-ভাষীর চাকরি করে। আর মাত্র বছর চারেক চাকরি আছে। তাই জমে থাকা ছুটিগুলো নিয়ে কলকাতায় এসেছে। এখন যাদবপুরে মামার বাড়িতে যাচ্ছে। তবে, কথা দিয়েছে ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার আগে একবার আমার বাড়ি আসবেই আসবে।

হঠাৎ দেখা হওয়াতে আমরা দুজনেই কেমন যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছি। ট্রেনের অনেকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। আমরা সব ভুলে পুরোনো দিনের কথায় মেতে উঠলাম।

শম্পারা আর আমরা একই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। বাড়িটা তৈরি হয়েছিল একটা কবরখানার উপর। ওর সঙ্গে দেখা না হলে এই গল্পটা হয়তো কোনদিনই লেখা হতো না!

ঘটনাটা ১৯৭৮ সালের।

আমাদের তখনও নিজেদের বাড়ি হয়নি। সোনারপুরে ভাড়াবাড়িতেই থাকতাম। বাবা চাকরিসূত্রে বাইরে থাকতেন। সেভাবে বাড়ি তৈরির তাগিদও তিনি অনুভব করেননি তখনও। আজ এখানে তো কাল ওখানে বাড়ি ভাড়া করে থাকতাম আমরা। তখন আমি খুব ছোট। সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছি। বাবা আর বড়দা খোঁজ করে করে বারুইপুরেই একটা ভাড়াবাড়ির সন্ধান পেলেন।

বারুইপুর স্টেশন সংলগ্ন মদারাট রোড। মদারাট পপুলার একাডেমি ছেড়ে একটু এগিয়ে গেলেই সেই বাড়িটা, যেটা নিয়েই এই গল্প লেখা শুরু করলাম। বাড়িটাকে কেউ বলতো হোড় সাহেবের বাড়ি। আবার কেউ কেউ বলতো “কবর খানার ঘর”।

বাড়িটা দোতলা। রাস্তা, দোকান, বাজার, স্কুল, ফার্মেসি, ডাক্তারখানা সবই বাড়ির সামনে। এমনকি দোতলার বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে হাত দেখালে কন্ডাক্টার বাস থামাতো প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্য। ওই রাস্তা দিয়েই সেইসময় 97/97A এই দুটো বাস চলতো। চম্পাহাটি সীতাকুন্ডু, মদারাট, ঘটকপুকুর আমতলা। সম্ভবতঃ এটাই রুট ছিল।

যাই হোক, আমার বাবা-দাদা এতসব সুবিধাযুক্ত ওই বাড়িটার খোঁজ পেয়ে ঠিক করলেন ওটাই নেবেন। একতলায় একটা ভাড়াটে পরিবার থাকেন। সবে তিনমাস হলো তারাও এসেছেন। তাই দোতলার ঘরগুলো আমরা ভাড়া পেলাম।

বাড়িওয়ালা হোড় সাহেব পুলিশে চাকরি করতেন। তাঁরও বদলির চাকরি। তাই,তাঁকেও সবসময় পরিবার নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হতো। ওনার চার মেয়ে। তারা বড়ো হওয়ার পর ওনার গিন্নির ইচ্ছেতে এবং ভবিষ্যতের ব্যবস্থা হিসাবে উনি এই জায়গাটা কিনেছিলেন একেবারে জলের দরে। তারপর সেই জমিতে উনি বাড়িও করেন।

কিন্তু, জমি কিনে বাড়ির ভিত কাটা শুরু করা থেকেই নাকি পরপর অনেক অঘটন ঘটছিল। উনি নাকি সে সব নিছকই কাকতালীয় বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। শুনেছি বাড়ির গৃহ প্রবেশের দিন পুজোর প্রসাদ খেতে খেতে নাকি আচমকা কমলা লেবু না কুলের দানা গলায় আটকে গিয়ে তাঁর ছোট মেয়েটা মারা যায়। তারপর থেকে তিনি এই বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতে পারেন নি। তাই বাড়িটা ভাড়ায় দিয়েছেন। আমরা আর শম্পারা ভাড়া আসার আগেও একতলা দো-তলা মিলিয়ে আরও কয়েকটা পরিবার ভাড়া নিয়েছিল কিন্তু কেউই ছ’মাস বা একবছরের বেশি থাকেনি। কারণটাও তখন নিছকই অজানা ছিল আমাদের।

পুলিশের চাকরির সুবাদে হোড় সাহেবের আর্থিক অবস্থাও বেশ সচ্ছল ছিল। তিনমাস অন্তর এসে ভাড়া নিয়ে যেতেন। উনি বলেছিলেন, প্রতিমাসে এসে ভাড়ার জন্যে তাগাদা দেওয়া আমার পছন্দ নয়। তাই তিনমাস বাদে বাদে আমি আসবো। আপনারা ভাড়ার টাকা রেডি করে রাখবেন। সেই কথা মতো আমার বাবা এবং একতলার অরবিন্দ কাকু ভাড়ার টাকা রেডি রাখতেন।

বাড়িটা যে একটা কবরখানার উপর তৈরি হয়েছিল তা আমরা কেউই জানতাম না। আশেপাশের প্রতিবেশীরা পরে পরে অনেক ঘটনা বলেছিল।

হোড় সাহেবের বাড়ির পজিশনটা খুব ভালো ছিল। রাস্তার ধারে অনেকখানি জায়গার উপর বাড়ি। সামনে সুপারি গাছের সারি। বাড়ির পিছনের দিকে অনেকখানি জায়গা, সেখানে আম কাঁঠাল পেয়ারা, সবেদা, কালোজাম, জামরুল আর দু’একটা টগর আর জবা ফুল গাছ ছিল। আর বাগানের শেষ প্রান্তে একটা খুব গভীর এবং বিশাল বড় ইঁদারা ছিল! অত গাছ-গাছালির জন্য খুব বেশি আলো ঢুকতো না বাগানে। কখনো-সখনো সকালের দিকে এক ফালি রোদ গাছের আড়াল থেকে এসে পড়লেও দুপুরের পর থেকে বাড়ির পিছনে বাগানের দিকটায় আবছা আড়াল পড়ে যেতো। তখন কেমন যেন একটা ছায়া ছায়া পরিবেশ হয়ে উঠতো।

ওই বাড়িতে ভাড়া যাওয়ার পর আমাদের সকলেরই দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। আমরা ছোটরা বেশ মজায় ছিলাম। একতলার ভাড়াটে অরবিন্দ কাকুর পরিবারের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব-সাব হয়ে গিয়েছিল। একবাড়িতে থাকলে যা হয় আর কি। ওনারাও মাস-চারেক আগেই এসেছেন। অরবিন্দকাকু ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। জামসেদপুরে টেলকো’তে(বর্তমানে টাটা মোটরস) উনি চাকরি করতেন। চার ছেলেমেয়ে টুম্পা-শম্পা-রিম্পা-আর ছোট ছেলে লাল্টু, বেশ সম্পন্ন এবং শিক্ষিত পরিবার ওঁরা। লাল্টু বাড়ির কাছেই ইংলিশ-মিডিয়ামে লোয়ার সেকশনে পড়তো। বারুইপুরে খুব নামকরা গার্লস স্কুল “রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়”। আমিও শম্পা-রিম্পাদের সঙ্গে ওই স্কুলেই ভর্তি হলাম। যাওয়া-আসা এক বাড়ি থেকে একসঙ্গেই। নতুন বন্ধু পেয়ে খুশিতে কাটছিল দিনগুলো। অরবিন্দকাকু সোমবার ভোরে চলে যেতেন,আবার শুক্রবার রাতে ফিরে আসতেন। পুরো পরিবারটাই ভীষন মিশুকে। কাকু বাড়িতে থাকলে আমাদের আর পায় কে,খুব মজায় কাটতো সেইদিনটা।

প্রায় মাস ছ’য়েক কেটে যাওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝেই দু-একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল বাড়িটাতে। সন্ধ্যের পর বেশ ভয় ভয়, গা ছম ছম করে উঠতো। কিন্তু আমরা ছোটরা বললে, কেউ বিশ্বাসই করতো না। এর মাঝে দুবার হোড় সাহেব ভাড়া নিতে এসে জিজ্ঞাসা করেছেন কেমন লাগছে এখানে? কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? (আমি জেঠু বলতাম ওনাকে) বাবা বলেছেন না না, ঠিকই আছে। আর এতো ভালো বাড়িটা আপনার, তাতে অসুবিধার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি একবার আগ বাড়িয়ে জেঠুকে বলতে গিয়েছিলাম যে, সন্ধ্যে হলে কেমন ভয় ভয় করে। কিন্তু বাবার ভয়ে বলতে পারিনি।

বাড়িটা ছিল এইরকম…….

মেন রাস্তার পাশেই ছোট একটা মাঠের ওপারেই বাড়িটা। রাস্তা থেকে সোজা এসে বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের গেট দিয়ে ঢুকেই আবার গেট। সেই গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে নীচে শম্পাদের ঘর আর সোজা সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। সেখানেও একটা ছোট গেট। যাতে চট করে কেউ দোতলায় উঠে আসতে না পারে। ওই দোতলায় আমাদের ঘর। উপর-নিচ একই প্যাটার্ন। গেট দিয়ে ঢুকেই লম্বা একটা বারান্দা। তার মাঝখানে একটা ঘরের দরজা আর বারান্দার শেষে আরেকটা ঘরের দরজা। দুটো ঘর পাশাপাশি। ভেতরে বারান্দা, তারপর রান্নাঘর, রান্না ঘরের পাশেই এক ফালি প্যাসেজ। সেখানে তিনটে ছোট ছোট ঘর। একটা শুধুই বাথরুম, একটাতে স্যানিটারি প্যান বসানো, অর্থাৎ সেটা পায়খানা আর অন্যটা স্নান-বাথরুম। ওই পায়খানা-বাথরুম আর স্নান-বাথরুমের পুরো অংশটাই বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে পড়ে। তবে, বারান্দা, প্যাসেজ সমেত পুরো বাড়িটাই গ্রীল দিয়ে ঘেরা। দোতলায় উঠে সামনের ঝুল-বারান্দায় হাফ গ্রীল দেওয়া আছে।

সন্ধ্যেবেলা বাথরুমে গেলেই মনে হতো জানলা দিয়ে কেউ যেন মুখ বাড়িয়ে দেখছে। তাকালে দেখি কেউ নেই। কতদিন এমনও হয়েছে যে,বাথরুমে গিয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছি ঘরে। প্রথম প্রথম বাড়ির বড়োরা কেউ বিশ্বাস করতো না। এমনকি আমরা সবাই হয়তো ঘরে রয়েছি, হাসি-গল্প করছি, হঠাৎ রান্না ঘরের তাক থেকে দু-তিনটে বাসন পড়ার আওয়াজ হলো। মা গিয়ে দেখে কেউ নেই! বাবা রেগে গিয়ে বলতেন, এটা মায়েরই দোষ। কারণ মা নাকি বাসনগুলো ঠিক মতো তাকেতে গুছিয়ে রাখতে পারে না। সবাই একঘরেতে বসে থাকলে হঠাৎ মনে হতো ভেতর বারান্দা দিয়ে কেউ বুঝি হেঁটে চলে গেল। শুধু আমার বাবা’ই কিছু দেখতে বা বুঝতে পারতো না। আর বড়দা তো সেই সকালে বেরোতো আর রাতে এগারোটার পর ফিরতো, তাই ওসব খেয়াল করতো না।

বাসন পড়লেই মায়ের পিছন পিছন আমি নয়তো অন্য কেউ উঠে গেলে প্রতিবারই দেখতে পাওয়া যেতো একটা কালো বিড়াল মেঝে থেকে লাফিয়ে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে যাবার সময় বিড়ালটা মুখটা ঘুরিয়ে তাকাবেই! জানলার বাইরে গেলেই সেটা নিমেষে মিলিয়ে যেতো।

এই কুচকুচে কালো বিড়ালটা প্রায়ই আসতো সন্ধ্যের পর। হঠাৎই চলে যেতো। রেশমের মতো ঝলমলে কালো তার লোমগুলো আর হাড়হিম করা তার হলুদ রঙের চোখে গাঢ় কালো মণি। মণিটার মাঝখান থেকে লম্বা কালো দাগ।

আমার মা বলতো, চতুর্দিক গ্রীল দিয়ে ঘেরা দোতলার ঘরে কি করে যে বিড়াল ঢুকে আসে তা কে জানে বাব্বাঃ! তার উপর যা দেখতে, একেবারে ভয় ধরিয়ে দেয়! শুনে বাবা বলতেন, বিড়াল খুব ভালো গাছে উঠতে পারে। ওই পেয়ারা গাছ বেয়েই হয়তো উপরে উঠে আসে।

সে সময় সন্ধ্যে হলেই লোডশেডিং অবধারিত। দু’ ঘরে দুটো হ্যারিকেন আর বারান্দা এবং প্যাসেজে একটা করে দুটো কাঁচের চিমনি জ্বলতো। কারেন্ট আসতে দেরি হলে মা রান্নাঘরে একা বসে রুটি করতে পারতো না। আমাদের কাউকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে বসিয়ে রাখতো। আমি আর আমার দিদির ছেলে ভোলা মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে থাকতাম আর মাখা আটা নিয়ে খেলা করতাম।

আমার বাবা ছিলেন ভীষন রাগী এবং রাশভারী মানুষ। তাঁর সামনে গিয়ে কিছু বলার সাহস আমাদের কারোরই ছিল না। আমরা ভাইবোনেরা খুব ভয় পেতাম বাবাকে। তাঁর ধারেকাছে যাওয়া তো দূরের কথা, কখনও আব্দার করে কিছু বলতেও যেতে পারিনি। তিনি বাড়িতে থাকলে বাড়ি নিঃস্তব্ধ থাকতো। এমনকি মাকেও দেখেছি তাঁকে বেশ সমঝে চলতে।

তিনিও একদিন মাঝরাতে নাকি কিছু একটা দেখে চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু স্বীকার করেননি কি দেখেছেন তিনি! তবে মাঝরাতে বাথরুমে গিয়ে বাবা নাকি সেদিন ছুটে বেরিয়ে এসেছিলেন, তা আমার মায়ের চোখ এড়ায়নি। আর কালো হিজাব পরা মহিলাকে তো আমরা ছাড়া পাড়ার লোকেরাও প্রায় সবাই দেখেছে কখনও না কখনও,সন্ধ্যে থেকে রাতের মধ্যে!

স্কুল ছুটি থাকলে, শম্পা-পম্পাদের সঙ্গে আমি পিছনের বাগানে খেলতাম। কারণ,দুপুরবেলা আমাদের বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ ছিল। গ্রীষ্মের দারুণ গরমে, মায়েরা যখন কাজ সেরে বিশ্রাম করতো, আমি আর ভোলা চুপি-চুপি উপর থেকে নেমে শম্পাদের ডেকে নিয়ে পিছনের বাগানে খেলতাম। ভোলা আমাদের কাছেই থাকতো। বাড়ির কাছেই বয়েজ স্কুল। তাই সে মামার ভারী থেকেই পড়াশুনা করবে এটাই ছিল আমার বাবার আদেশ। তাতে কেউ বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি। ভোলা আর আমি প্রায় সমবয়সী। তাই সে আমার সবসময়ের সঙ্গী ছিল।

একদিন দুপুরে আমরা বাড়ির বাগানে খেলছি। কখন যেন শম্পার ভাই একা একা পিছনের দিকের ওই ইঁদারার কাছে চলে গিয়েছিল। খেলার ঝোঁকে আমরা খেয়াল করিনি! হঠাৎ ওর দিদি দিদি বলে চিৎকারে, ছুটে গিয়ে দেখি লাল্টু কুয়োর পাশে পড়ে ছটফট করছে। আর তার চোখ উল্টে কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। ভাইয়ের কিছু হলে মা বকবে তাই ওর দিদিরা তাড়াতাড়ি ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। সেই দেখে আমিও ভোলার হাত ধরে ছুটে ওদের সঙ্গে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আমার মধ্যে তেমন কোনও ভয়-ডর ছিল না। ভোলা আমার হাত ধরে টানছিল,কিন্তু লেগেছে বলে উঠতে পারছিলাম না।

ওই ইঁদারার ধারে খেলতে খেলতে আগে একদিন আমরা অনেক হাড়গোড়, মাথার ভাঙা খুলি পেয়েছি। এসব শুনে অরবিন্দ কাকু আর আমার বাবা-মাও বকাবকি করেছিল যাতে ওখানে আমরা আর না খেলি। কিন্তু খেলার ঝোঁকে ভর-দুপুর হলেই পিছনের বাগানটা যেন ভীষণ ভাবে আমাদের টানতো। তখনই সবাইকে ডেকে নিয়ে বাগানে চলে যেতাম খেলতে।

শম্পার ভাইয়ের সেদিন রাত থেকে ধুম জ্বর, সে জ্বর কিছুতেই ছাড়ছিল না। ক’দিন ধরে যমে-মানুষে টানাটানি চলেছিল। কাকু আমার বাবাকে বলল, জ্বরের ঘোরে ছেলেটা খালি কুয়োর ধারে,কুয়োর ধারে বলে কি যেন বলতে চাইছে! ডাক্তারবাবু বলেছেন,কোনও কিছু থেকে ভয় পেয়ে জ্বর এসেছে, চিন্তার কিছু নেই। সপ্তাহখানেক পর শম্পার ভাই লাল্টু সুস্থ হয়ে উঠল বটে কিন্তু ওই জ্বরের পর থেকে ওর শরীরটা সবসময় কেমন যেন অসুস্থ থাকতো।

একবার ওই বাগানে অনেক চুড়ি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। শম্পারা আর আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম। শোবার ঘরের খাটের তলায় আমার খেলনার প্যাকেট রাখা থাকতো, কুড়োনো চুড়িগুলো ওই প্যাকেটে রেখে দিয়েছিলাম। সেদিন মাঝরাতে আমার খেলনার প্যাকেটে খচ্ খচ্ শব্দ পেয়ে ভয়েতে আর উঠিনি, মাকেও বলিনি। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্যাকেট খুলে দেখি চুড়িগুলো নেই! ছুটে নিচে নেমে শম্পাকে বললাম রাতের কথা। ও গিয়ে দেখে ওর চুড়িগুলো আছে। তবে আমার কুড়িয়ে পাওয়া চুড়িগুলো কোথায় গেলো! এটা আমার বার বার চিন্তা হচ্ছিলো, কারণ মনে আছে ওগুলো আমি ব্যাগের মধ্যেই রেখেছিলাম।

আমরা ছিলাম সাত ভাইবোন। আমাদের স্কুলের গায়ত্রী দিদিমণি এমন অসাধারণ সুন্দর করে ইংরেজী পড়াতেন যে, তা একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে যেতো। আজও ভুলিনি তার পড়ানো “দ্য লিসেনার্স” বাই ওয়াল্টার ডে লা মেরা এবং “উই আর সেভেন” বাই উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। ঘটনা প্রসঙ্গে মনেও এসে গেলো সেই ইংরেজি কবিতার কথা। কারণ কোনওকিছু ঘটনা বলার সময় আমিও সবসময় আমাদের সাত ভাইবোনের কথা বলতে ভুলি না। এই ‘কবরখানার ঘর’ এ তখন আমরা সব্বাই ছিলাম।

হোড় সাহেবের বাড়িতে ভাড়া আসার মাস কয়েক আগেই আমার বাবার রিটায়ারমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত পরপর দুবার স্ট্রোক হয়ে যাওয়ায় অফিস থেকে সেচ্ছাবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন তিনি। তাঁর চাকরির পূর্ণ মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে তখন দশবছর বাকি ছিল। বড়দির বিয়ে হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। মেজদিকে সুন্দর দেখতে হলেও সে একটু রুগ্ন ছিল। সারাবছরই প্রায় অসুস্থ থাকতো। তাই হঠাৎই ভালো সম্বন্ধ পেয়ে আমার সেজদির বিয়ে হয়ে গেল।

দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়কে বলে কয়ে একটা চাকরির খোঁজ পেয়ে বাবা সেজদাকে নাগপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার বড়দা-বৌদি দুজনেই প্রতিষ্ঠিত সংগীত-শিল্পী। ওদের প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় গানের প্রোগ্রামে যেতে হতো। ভালো শিল্পী হওয়ার সুবাদে প্রায় রোজই বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানে ডাক পড়তো দাদা-বৌদির। সেইসময় প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ফাংশন লেগেই থাকতো। বাকি আমরা ছোট দুই ভাইবোন আর দিদির ছেলে স্কুলে পড়তাম।

দাদা একদিন একটা ফাংশনে গিয়েছিল। বাড়িতে বলে গিয়েছিল রাতে ফিরতে পারবে না। বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাবে। ভাইপোটা খুব ছোট ছিল বলে বৌদি দূরে কোথাও গানের অনুষ্ঠানে যেতো না। দাদা না থাকলে রাতে বৌদির কাছে আমাকে শুতে হতো। সেদিন রাতে বৌদি ও আমার কারোরই ঘুম আসছিল না। অনেক্ষণ জেগে থাকার পর কখন যেন দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো, দেখি বৌদিও ভয়েতে আমার হাতটা চেপে ধরেছে।

দুজনেই কান পেতে শুনছি…… প্রথমে খস্‌ খস্‌ করে কিছু একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ হলো! তারপর, ছাদের উপর কেউ যেন ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে দিচ্ছে আর ঝর ঝর করে সেই জল ছাদের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। প্রথমে ভেবেছি বৃষ্টি পড়ছে,কিন্তু উঠে দেখার সাহস হয়নি। এমন ঘটনা একদিন নয় প্রায়দিন রাতেই বাড়ির কেউ না কেউ শুনতে পেতো।

পাড়ার লোকেরা সবাই জানতো যে ওই বাড়িটা তৈরির আগে জায়গাটা ছিল একটা কবরখানা। মানুষজন সাময়িক ভয় পেলেও শুনেছি শ্মশান, কবরখানা বা সমাধিক্ষেত্র এগুলো সাধারণতঃ পবিত্র স্থান। সেই হিসাবেই নাকি হোড় সাহেবও এই জমিটা কিনেছিলেন এবং সেখানে বাড়িও তৈরি করেছিলেন।

ওখানে থাকতে থাকতে আশেপাশের বাড়িগুলো ও তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বাড়িতে থাকতো। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা বাড়ি ছিল। তাদের নাকি কয়েক পুরুষ ধরে ওখানেই বসবাস। তাদের গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, আম, জাম কাঁঠাল গাছ। দালানকোঠাসহ লম্বাটানা একচালা বিশাল একবাড়ি। তবে ওই বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে ১৮-২০ বছর বয়সী বাপ্পাদিত্য ছাড়া কেউ নেই। বাপ্পাদিত্যর বাবা চাকরিসুত্রে ত্রিপুরায় থাকতেন। বছরে এক-আধবার বাড়ি আসতেন। বাপ্পাদিত্যের চার বোন শিবেস্বরী, মনোময়ী, সিদ্ধেস্বরী ও সুধাময়ী। শিবেশ্বরী ও মনোময়ী অন্য স্কুলে পড়লেও তারা আমাদের খেলার সঙ্গীহলো,পাড়ার বন্ধু হলো। এপারে দাসেদের বাড়ি, তার পাশে সান্টুদের বাড়ি, ডানদিকে মায়াদি, কাজল, বিকাশ স্বপনদের বাড়ি। আর ছিল হারুণ, হোসেন, খইরুল আর তার দাদা কামরুলদের বাড়ি। ছিল শুকুর আলি, নুরুল, হামিদ, মজিদ, রোজিনা, গুলশন, সেলিনা ও ফুজরুলরাও। ছিল স্নিগ্ধা, মনীষা আর ইকবালরা। পাড়ার সকলের সঙ্গে সকলের বেশ সম্প্রীতির সম্পর্ক ছিল। কেউ ছিল বিকেলে খেলার সাথী, কেউ স্কুলের আর কেউ শুধুই পাড়ার বন্ধু-প্রতিবেশী।

শিবেশ্বরীর মা ছাড়াও ওদের বাড়িতে থাকতো ওর দিদিমা এবং দিদিমার মা ও মাসি। তারা তখনও বেঁচে। তাদের বয়স সত্তর, নব্বই এবং পঁচানব্বই। ওদের বাড়ির বিশেষত্ব ছিল মেয়েরা কেউ কখনও শ্বশুরবাড়ি যায়নি। তারা সকলেই বাল্যবিধবা আর তারা সারাজীবন বাপের বাড়িতেই থেকেছেন।

বিকেলে মনোময়ীদের বাড়ির উঠোনে আমরা খেলতে যেতাম। ওর দিদিমার মা আর মাসিকে ওদের থেকে শুনে শুনে আমরাও সবাই বলতাম মণিদিদা আর মাসিদিদা। মনিদিদা বলতেন,এই কবর স্থানে কত কি ঘটনা নাকি ওরা ঘটতে দেখেছে জ্ঞান হওয়া থেকে। কত মানুষের কবর খোঁড়া দেখেছে। রাতে কবর থেকে আত্মাকে উঠে ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখেছে আবার নাকি তাকে ফিরে গিয়ে কবরেও ঢুকতে দেখেছে।

একদিন বিকেলে মনোময়ীদের বাড়িতে খেলতে গিয়ে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা এবং পাড়ার অন্যসব ছেলেমেয়েরা সবাই দল বেঁধে ওদের বিশাল বড়ো লম্বা টানা বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। মণিদিদাকে ধরলাম গল্প বলার জন্যে। মণিদিদা খুব ভালো গল্প বলতো। আমি দিদাকে বললাম জানো দিদা, কাল রাতে আমাদের ছাদে মনে হচ্ছিলো কেউ ঘড়া ঘড়া জল ঢালছে আর কার্নিশ বেয়ে জল পড়ছিলো। দিদা বললো, এতো প্রায় প্রতি রাতেই হয়! আমরাও কতবার তাকে দেখেছি জল ঢালতে। তারপর বললো, শোন…তাহলে তোদের বাড়ির আসল ঘটনা।

~ আগামী পর্বে সমাপ্য ~
 

শ্রাবণী চ্যাটার্জি

 

লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ-ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়।

শখ- হস্তশিল্প নাচ, নাটক, আবৃত্তি, সেলাই, ফেব্রিক, উল বোনা,রান্না, আর ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে সুন্দর শো-পিস তৈরি করা। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং পাখী পরিচিতি নিয়ে লেখাও শুরু করেছেন।

“জীবন ও গল্প অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। যা দেখি, যা শুনি, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে, তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করি।”

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!