কলমে : পুষ্পিতা বরাট
এখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে সেই দশটার থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে মুষলধারে বলতে পারা যায়। আজ সারাদিন ধরেই কম বেশি বৃষ্টি হয়েই চলেছে। এইরকম সময় পুরানো বাড়ি ভেঙে পড়ার খুব ভয়ে থাকে। এই মুহুর্তে বৃষ্টিটা একদম সোজা পড়ে যাচ্ছে। তাই ভাবলাম জানলাটা খুলে একটু বাইরের দৃশ্যটা দেখি।
কি আর দেখতে পাব, লাইট নেই, নিকষ কালো অন্ধকার রাত্রি… হ্যাঁ, জোনাকির ঝিকিমিকি আলো আছে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে আর আছে আকাশে মেঘ চিরে বিদ্যুতের চমক তাতেই খানিকটা পরিসর আলোকিত হয়ে উঠছে আর সেই রকমই মেঘের গর্জন। মেঘ ডাকার আওয়াজে পিলে চমকে উঠছি… নাঃ… ঘুম তো আসবেই না, তার চেয়ে ভালো ছোটোবেলায় বাবার কাছে শোনা ঘটনার বর্ণনাটা কাগজে লিখেই ফেলি। আমার এই ঘরে অবশ্য ব্যাটারির লাইট আছে তাই কাগজ কলম নিয়ে বসলাম ঠিক এইরকমই বর্ষা রাতেরই ঘটনা তবে নিশ্চয়ই সেই সময় পরিস্থিতিটা অনেকটাই ভয়াবহ হয়ে থাকবে, কারণ এই ঘটনাটা আমার বাবার মামাদাদুর জীবনে ঘটেছিল… সেকি আর আজকের কথা।
B7/167 পাণ্ডে হাভেলি বেনারসে বাড়ি বাবার সেই মামাদাদুর বাড়ি তিনি পেশায় ডাক্তার ছিলেন। তাঁর একখানা ঘোড়ার গাড়ি ছিল। গাড়ির সহিস বাড়িতেই থাকতো। সে বাড়ির, গাড়ির ও ঘোড়ার দেখভাল ও করতো। তা এইরকম এক ভয়াবহ বর্ষা রাতে হঠাত্ করেই সদর দরজায় শেকল পেটানোর আওয়াজ আসে। তুমুল ঝড় বৃষ্টির আওয়াজের মাঝে এই শিকলের আওয়াজটা শুনে সহিস আজিমুলের মনে একটা ভয় সঞ্চার হলো সে ঘরের জানলা টা খুলে আওয়াজ দিল কৌন হৈ…..কৌন হৈ ইতনি রাত কো? ডাক্তার সাহেব মরিজ দেখনে জানা হি পড়েগা। আরে অভি কৈসে না না সুবহ আনা। নহি হুজুর মরিজ কা হালত বহুত খরাব হৈ বচা লিজিয়ে ডাক্তার সাব। আজিমুল এবার তাকে দেখতে পায় সে বৃষ্টিতে ভিজেই চলেছে আর হাত জোড় করে একটি প্রাণের ভিক্ষা করেই চলেছে। তার এবার খুব কষ্ট হয় সে বললো, দাঁড়াও… দেখছি তোমার জন্য কি করতে পারি।
আজিমুল তখন উপরে গিয়ে সিঁড়ির দরজায় ঠকঠক করে ডাক্তার বাবু উঠে এসে ব্যাপার জানতে চান রাত তখন দুটো বাজে।
আজিমুল বলে, দয়া করুন ডাক্তার বাবু। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেই চলেছে, যদি মরিজের প্রাণটা বাঁচানো যায় আল্লাহ্তালার দয়ায়।
ডাক্তার বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে সে বললো গাড়ি নিকালে সাহেব।
তিনি বললেন কোথায় যেতে আছে ।
সে বলে ও তো বললো যে ওই রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে রামাপুরার দিকে।
আচ্ছা তবে তাই, বলে ডাক্তার বাবু পিছন ঘুরলেন তৈরী হতে আর দেখেন যে গিন্নি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আর বলছেন এই দুর্দিনে কি না গেলেই নয়।
না গিন্নি সেবাই যে আমার ধর্ম। আজিমুল তো সঙ্গে আছে তুমি একদমই চিন্তা কোরো না এই বলে তিনি তো ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে বসলেন। সেই লোকটিও আজিমুলের পাশে গিয়ে বসলো। ঘোড়া ছুটছে নির্জন দুর্যোগ ভরা বিভীষিকার রাতে মনে হচ্ছে যেন ছুটছে তো ছুটছেই। আন্দাজে মনে হলো রামাপুরার দেবকী নন্দন হাভেলি পার হয়ে অলি-গলিতে ঘোড়া ছুটছে। এবার এক জায়গাতে সেই লোকটি বললো, দাঁড়াও এসে গেছি আমরা।
আজিমুল গাড়ি থেকে নেমে সস্নেহে ঘোড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, এখানেই দাঁড়াবি যতক্ষণ না ফিরে আসছি। তারপর হাতে বড়ো টর্চ নিয়ে ডাক্তারবাবুকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল। এবার ঘরে ঢোকার পালা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হবে তাই সই। প্রথমে সেই লোকটি উঠছে, তারপর এনারা। দুইজন ডাক্তার বাবুর ব্যাগ সেই লোকটির হাতে।
একবার মনে হল বাড়িটা যেন বহুকাল মানুষ বিহীন পরিত্যক্ত। না…না! তা কি করে হয়? এখানে তো পেশেন্ট রয়েছে। ভাবলেন ডাক্তার বাবু।
এবার তারা পেশেন্টের ঘরে পৌঁছালো সে ঘরে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো জলছে। বাইরে বৃষ্টির দাপট টা একটু কমেছে মনে হচ্ছে। রুগির কাছে একটি চেয়ারে যখন বসলেন তখন রুগি বললেন আপ আ গয়ে ডাক্তার সাহেব বহুত সময় সে ইন্তেজার কর রহে থে আপকা। মুঝে বহুত তকলিফ হৈ ব …. হু …ত হি জাদা। পেশেন্ট আরও একটা কথা বললেন যে ওনার খুব কষ্ট গায়ে হাত না দিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করেই ঔসধ দিতে। আলো আঁধারে যতটা পারলেন কথা বলে আর দুর থেকে দেখেই ওষুধ পালা লিখে দিলেন। অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা হাতে, হাত বাড়িয়ে চারখানি মোহর টেবিলের ওপরে রেখে বললেন এর চেয়ে বেশি আর দিতে পারলাম না ডাক্তার বাবু। কৈলাসকে বললেন, ইন্হে নীচে তক ছোড় আও। জী হুজুর বলে সে দুজন কে নিয়ে নিচে নামলো। দুর্যোগটা অনেকটাই কমেছে তবে চারিদিকে থম থমে ভা টা রয়েছে ব্যাঙ, ঝিঁঝির পরিত্রাহি চিত্কার জোনাকির ঝিকিমিকি আলোর মাঝে আবার ঘোড়া ছুটলো বাড়ির পথে।
মামাদাদুর মনে তো ভারি আনন্দ চারখানি মোহর পেয়ে। ওহ্ বাড়ি গিয়েই গিন্নি কে দেখাতে হবে।
যথারীতি বাড়ি ফিরে গিন্নিকে সব ঘটনা বিস্তারিত বলে মোহর গুলি দেখালেন তারপর একটা কৌটো তে ভরে টেবিলের উপর রাখলেন সকালে আবার ভালো করে দেখে তুলে রাখবো। যদিও সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই তবু ও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে বইকি।
যথারীতি সকালে মোহরগুলি দেখতে কৌটোটি হাতে নিলেন। গিন্নিও এসে পড়েছেন। আজিমুলও কিছু বলার জন্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু… আরে একি! মোহর গুলি কারুকাজ করা সোনার নয় মাটির হলো কি করে? কি করে সম্ভব? রাত্রিতে তো এমন ছিল না। চকচকে শক্ত জিনিস একদম সোনার মতোই ছিল আমি নিজে হাতে নিয়ে দেখেছি ডাক্তার বাবু বলিলেন।
আজিমুল বললো মৈ কুছ বোলুঁ কয়্যা ?
হাঁ হাঁ… বোলো।
কল ও আদমি যো বৈঠা মেরে পাস ও কুছ আজিব হি থা। ইতনা পানি মে ভিগা আদমি পাস বৈঠা তো বিলকুল সুখা থা ও কৈসে ?
ডাক্তার বাবু বললেন, আজিমুল তুম মুঝে অভি লে চল সকতে হো ?
জি সাব কেঁও নহি হম তো কয়্যা হমারী বিন্দু (ঘোড়ী ) হি দরওয়াজে তক পহুঁচা দেগি।
চলো ফির তৈয়ার হোতে হৈঁ।
আবার গাড়ি ছুটলো রামাপুরার অলী গলি তস্য গলি হয়ে ঠিক রাতে আসা বাড়িটির সামনে ঘোড়ি বিন্দু দাড়িয়ে পড়লো।
আরে ইয়ে কেয়্যা মকান তো য়েহী থা পর ইসমে তো তালা লগা হৈ আর ও ভি বরষোঁ পুরানা।
ডাক্তারবাবু তালাটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই খুলে গেল তালাটা। তারপর রাম- রহিমের নাম নিয়ে দুজনেই পা বাড়ালেন ঘরের ভিতর দিকে। হ্যাঁ সেই সিঁড়ি রয়েছে তা দিয়ে উপরে উঠে গেলেন সেই ঘরটিও দেখতে পেলেন যেখানে রুগি শুয়ে ছিল পাসে পাথরের বড়ো টেবিলটাও রয়েছে সেই চেয়ার যেটাতে গতকাল রাতে বসেছিলেন তাও আছে। রয়েছে বিছানা পাতা খাট তবে হ্যাঁ কেউ শুয়ে নেই কোনো রুগি নেই।
বহুকাল বন্ধ থাকার একটা পুরোনো সেই বাজে গন্ধটা রয়েছে এই গন্ধটা গতরাতে ও ছিল এবং সেই জন্য একটা সিগারেট ও ধরিয়ে ছিলেন তবে রুগির কথা ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই নিবিয়ে টেবিলের ওপর রাখা অ্যাস্ট্রেতে রেখে গিয়েছিলেন সেটিও তেমনি রাখা আছে।
নাঃ! বাড়ি ভুল হয়নি। দুজনেই চুপচাপ নীচে নেবে আসেন। সদর দরজাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজের সঙ্গে টেনে বন্ধ করলো আজিমুল, ছেকলটা তুলে তালাটা আটকে রাখার বৃথা চেষ্টা করে গেল।
ততক্ষণে বেশ কয়েকজন কৌতূহলী মানুষ তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ডাক্তার বাবু আপনি বাড়িটা দেখতে এসেছেন নাকি? কেউ বলে আপনি কি কিনছেন বুঝি।
আরে না না বিতে রাত তো হম ইসি হাভেলি মে মরিজ দেখনে আয়ে কোই বুলাকর লে আয়া। ঔর অভি দেখতে হৈঁ কি তালা লগা হৈ।
বাত কেয়্যা হৈ। হম তো উলঝন পড় গয়ে।
একজন এগিয়ে এসে বললো মৈঁ বতাতা হুঁ আপকো সারি বাত জিতনা মুঝে মালুম হয়।
য়ে হো গয়া আজ কম সে কম দস বারহ সাল পহলে কি বাত । বাবু নগেন্দ্র সিং (আজমগড়ী) কে নাম সে এক ব্যক্তি কভি কভি য়হাঁ আকর রহা করতে থে। ও আজমগড় কে রহনেওয়ালে থে ।উনকে সাথ কৈলাশ নাম কা এক লড়কা রহতা থা দেখভাল করনে কে লিয়ে। য়ে ভি শুনে থে কি ও বহুত বিদ্বান সজ্জন ব্যক্তি থে। বাত বহুত পুরানী হো গই পর ইতনা পতা কি ও ইলাজ কে বগৈর গুজর গয়ে। ফির উনকে ঘর সে আয়ে হোঁগে কোই আগে ঔর কুছ পতা নহি। পর তব সে মকান বন্দ পড়া হৈ।
একজন এগিয়ে এসে বললেন ডাক্তার বাবু আপকো কোই গলতফহমী হুই হৈ, য়ে মকান নহি হো সকতা হৈ।
আমার বাবার মামাদাদু আর কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন, শায়দ। মনে ভাবলেন রাত্রিতে সেই রুগি তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি ডাক্তারবাবুর জন্য অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছিলেন। মিটে গেছে তার কাজ। মনে মনে আত্মার শান্তি কামনা করলেন তিনি।
আজিমুল ভয় পেয়েছে। সে ভাবছে রাত্রিতে তাহলে ডাক্তারবাবুকে কোথায় নিয়ে গেল। ডাক্তার বাবু আজিমুলের পিঠে হাত রেখে বললেন ভয়ে নেই আমি আছি। চল গাড়ি বাড়ির পথে নিয়ে চল। ঔর হ্যাঁ ঘর মে কুছ মত বতানা । নহি তো রাত মে নিকলনা হি মনা হো জায়গা সমঝে বলে খুব জোরে হেসে আজিমুলের ভয় কাটানো চেষ্টা করলেন।
এটা একটা কাকতালীয় ঘটনাই বলবো, যে ঘটনাটি আমি ছোটোবেলায় বাবার কাছে শুনেছি বিহারে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আর সেই ঘটনার বর্ণনা লিখতে বসেছি B7/167 পাণ্ডে হাভেলির সেই বাড়িটারই দোতলার একটা ঘরে।
~ সমাপ্ত ~