রহস্য ও ভৌতিকগল্প

অভয়

কলমে : সুদেষ্ণা মজুমদার

অনতিদূরে দেখা যাচ্ছে সেই স্বপ্নের সোনার কেল্লা। এরই ভিতর মনিকারের বাড়িটা একটু খুঁজলেই সেখানে হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে চুনী, পান্নার দ্যুতি। ‘সত্যিই কি পূর্বজন্ম বলে কিছু ছিল?’ আর, কিই বা ঘটে ইহ জন্মের পর? 

এখন থাক সে কথা, বেড়াতে এসে কি আর এসব তত্ত্ব ঘাঁটতে বসলে চলে? এসব আবার শোভনকে বললেই সে রাগ করবে। এসব তার এক্কেবারে নাপসন্দ! আর এসব নিয়ে ভাববই বা কেন আজ?! বিশেষতঃ চোখের সামনে যখন ঝোলানো রয়েছে, সারে সারে পুতুল নাচের রাজা-রানীর জুটি, আর জটায়ুর বিখ্যাত সেই ‘সোনার পাথর-বাটির’ দোকান, তারই পাশে রয়েছে আবার, রাজস্থানের রূপসীদের অঙ্গের শোভাবর্ধক; রুপোর অপূর্ব সব গয়নার দোকান! আমি আর শোভন আমাদের SLR ক্যামেরা কাঁধে, মেয়ে কোলে, নিবিষ্ট মনে, ‘শুট’ করতে করতে এগিয়ে চলেছি জয়সলমের দুর্গের দিকে। হঠাৎই, একটা পথের বাঁকে দেখা মিলে গেলো, ইয়া বড় গালপাট্টা আর লাল পাগড়ি বাঁধা এক বৃদ্ধ দ্বার-রক্ষকের। তাকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলছি, অমনি শোভন বললো, “ওই দিকে দেখো.” তাকিয়ে দেখি, সারেঙ্গী বাজিয়ে গান ধরেছে এক দম্পতি। আর একটু দূর এগিয়ে দর্শন পেয়ে গেলাম, কাঁচ বসানো, কালো ঘাগরা পরিহিতা কালবেলিয়া নাচের নর্তকীদের। উফ! ওরা যখন ঘুরে ঘুরে নাচে, ওই ঘাগরার মধ্যেকার অপরূপ সুতো আর কাঁচের কাজ, যেন চোখে মায়াবী আলোর ঝলকানি লাগিয়ে দেয়। মাঘের শেষ, হালকা শীত তখনও রয়েছে, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো, এ যেন এক সত্যিকারের স্বপ্ন রাজ্য।

ছোট্ট মেয়েকে বুকের কাছে একটা ঝোলায় ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে ততক্ষনে শোভন খুবই ক্লান্ত আর যথারীতি ক্ষুধার্তও! ওর তো আবার ‘প্রোটিন রিচার্জ’ না হলেই মুশকিল! একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে, সেখানেই গাইডকে বিদায় জানিয়ে, দিন শেষ করলাম আমরা। সন্ধ্যেবেলায়, বিখ্যাত হাভেলি গুলোতে বেড়াতে গিয়েছি, সেখানে, আশাতীত ভাবে, ‘মহারানী বাঁধনি শাড়ি’র এমন সম্ভার পেয়ে যাবো, ভাবতেও পারিনি। শাড়ি কিনতে এমন মজে গেলাম, যে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো। ভাবিনি চট করে চারিদিক এমন নিঝঝুম হয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই হঠাৎ ঝুপ করে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। মনে হলো পাওয়ার ফল্ট! শোভন আমাকে ভয় পাওয়াবার জন্য, ফেলুদাদের বেনারসের এগুলি ওগলি ঘুরে রাত্রের অভিযানের সিন’টা মনে করিয়ে দিলো। বেশ রোমাঞ্চকর লাগছিলো। কিছুটা হাসিঠাট্টার পর, যেই আমরা একটু চুপ করেছি, কেমন জানি, গা ছম-ছম করতে লাগলো। হাওয়ায়, একটা শিরশিরে ভাব। 

আবার কথা বলতে বলতে অন্ধকার ঠেলে চলেছি, এমন সময়ে সেই অন্ধকার ভেদ করেই এক রোগা, লম্বা, চালাক চতুর দেখতে, রাজস্থানি যুবক বেরিয়ে এসে বললো, “নমস্তে, না জেনে শুনে, এমন পথে পথে ঘোরা এসময় আপনাদের জন্য ঠিক নয়, আসুন, আমি আপনাদের পৌঁছে দিচ্ছি, কোন হোটেলে উঠেছেন?” ওর বেল্ট থেকে দেখলাম একটা লম্বা চেন ঝুলছে, যার অন্য দিকটা, ওর পকেটে ঢোকানো। পকেটটা যেরকম ফুলে আছে তা দেখে, আমাদের দুজনেরই কেমন জানি একটু অস্বস্তি বোধ হলো। কি জানি, ওটা ছুরি নয়তো?!

শোভন, ওর নাম জিজ্ঞেস করাতে বললো, ওর নাম ‘অভয়’। ছেলেটার মধ্যে যেন একটা বেপরোয়া হাবভাব! 

আমরা বললাম, “আমরা নিজেরাই চলে যেতে পারবো।  আজকাল তো গুগল ম্যাপ দেখেই…,” 

আমার কথা শেষ হতে না হতেই, থামিয়ে দিয়ে, সে বললো, “আপনারা তো বাঙালি?” আমরা তো হতবাক! ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম শুধু। তারপর সে ভাঙা বাংলায় বলতে লাগলো, “শুনেছি, রাজস্থানের ডাকুদের ওপর আপনাদের অনেক গল্পের বই-টই আছে! নিশ্চই পড়েছেন সে সব?” আমরা কি উত্তর দেব ভাবছি…অভয় আমাকে একটু হালকা ধমক দিয়ে বললো, “তবে কেন আর কথা বাড়াচ্ছেন? আসুন একটা অটো ধরিয়ে দিই।”

শোভন হাত তুলে বললো, “অগত্যা!” যেই অভয় একটু এগিয়েছে, অমনি শোভন আমার কানের কাছে ফিশ ফিশ করে বললো, “একটু এলার্ট থাকো!” কথাটা শুনেই, বুকের মাঝে একটা ধুকপুকুনি হতে লাগলো। অভয়ের মুখে বাংলা কথা শুনে কিছু তো একটা বলতে হয়! শোভন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি বাংলা শিখলেন কি করে?” অভয় কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে, অটো খুঁজতে আরো খানিকটা এগিয়ে গেলো। অভয়ের সাথে একটু দূরত্ব তৈরী হতেই, শোভন আমাকে চাপা গলায় বললো, “লাবণ্য তুমি আবার তোমার স্বভাব সুলভ গল্প জুড়ে দিওনা, প্লিজ! অনেক রাত হয়েছে, এখন আমাদের সঙ্গে শীর্ষা আছে, খেয়াল রেখো!” 

অটোর দেখা মিলতেই, সিটি মেরে অটো থামিয়ে, অভয় একটু পিছিয়ে এসে বললো, “নিন, এই অটোতে উঠে পড়ুন!” আমাদের প্রচন্ড চমকে দিয়ে, সেও দেখলাম, ড্রাইভার এর পাশে একলাফে উঠে বসলো! হাঁ হয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর যেন কোনো উপায়ই রইলোনা।

শোভন তবু একটা শেষ চেষ্টা করে বললো, “আপনি আবার কেন কষ্ট করছেন? এই অটো চালকটিকে আপনি সব বলে দিন, আমরা ওর সাথেই চলে যাই তাহলে!?”

অভয়ের চোখে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো মুহূর্তে… অট্টহাসি করে বললো, “ভয় পাবেন না, আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করবোনা, বাংলার সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ!”

অনেক্ষন নীরবতার মধ্যে দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম পথ। শেষমেশ এই অসহ্য নীরবতা কাটিয়ে, আমি অভয়কে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা অভয়, আপনি কি যেকোনো টুরিস্টকেই এতটা সাহায্য করেন? নাকি আমরা বাঙালি বলেই…” 

অভয় খানিক চুপ করে থেকে, হিমশীতল একটা বাঁকা হাসি হেসে বললো, “আমি গতজন্মে কলকাতার লোক ছিলাম!” বলেই, সে নিষ্পলক আমাদের দিকে চেয়ে রইলো।

আমার হাত দুটো ততক্ষনে জমে বরফ। শোভনের মুখ থেকে না চাইতেও বেরিয়ে এলো, একটা “আঁ” শব্দ! সামলে নিয়ে বললো, “রাত বিরেতে ঠাট্টা করছেন?” 

অভয় আরো কিছুক্ষন চুপ করে রইলো, তারপর, খুব মন কেমন করা একটা শুকনো হাসি হেসে, বললো, “আমি একজন জাতিস্মর!!!”  

আমার বুকের মধ্যেকার প্রচন্ড ধুকপুকানিতেও আমাদের ছোট্ট শীর্ষা তখনও ঘুমিয়ে কাদা হয়ে রয়েছে।

অভয় আবার ও বললো, “বিশ্বাস করুন! আমি সত্যিই একজন জাতিস্মর, আমার পূর্বজন্মের সব কথা মনে আছে!!!” 

ততক্ষনে শোভনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, এবার সে জোরে একটা “ হুঁহ,” শব্দ করে বললো, “এরপর কি আপনি বলবেন, আপনিই মুকুল ধর?” 

ওকে শান্ত করার জন্য, আমি তড়িঘড়ি বলে উঠলাম, “আঃ! ও মুকুলের কথা কি করে জানবে?” 

শোভন বিরক্তির সাথে একটু ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিলো, “ঠিক যেরকম ভাবে ও জানে যে, রাজস্থানের ওপর আমাদের অনেক ডাকাতের গল্পের বই আছে, ঠিক সেরকম ভাবেই!” 

অভয় অস্থির হয়ে উঠে, মাথাটা আমাদের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বললো, “আপনারাও আমাকে অবিশ্বাস করছেন!…

ছেলেটা মাথা চাপড়ে, স্বগতোক্তি করে বললো, “উফফ! কেউ বিশ্বাস করেনা আমাকে! …আমি জানতাম, আপনারাও করবেন না! ..গতজন্মে, আমার যে কলেজ ট্রিট এ একটা বই এর দোকান ছিল!”

শোভন তাতে আরও রেগে গিয়ে বলতে লাগলো, আরে, এই এলাকার সবাই জানে এবং মানে যে ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমাটা করে সত্যজিৎ রায় এই অজ্ঞাত জায়গাটাকে পৃথিবী বিখ্যাত করে তুলেছিলেন! দেখলে না, সব দোকানদাররাও তাই বলছিলো! ওরা বাঙালি টুরিস্ট দেখলেই, তাদের খুশি করার জন্য এইসব বলে আজকাল।” 

এইবার অভয়ের রেগে যাবার পালা। মাঝরাস্তায় হঠাৎ অটোটা থামিয়ে দিয়ে, অভয় বললো, “আমি এখানেই নেবে যাচ্ছি, আপনারা চলে যান!” সেই শুনে, আকস্মিকভাবে ভাবে অটো চালকও বলে উঠলো, “আমাকেও এখানেই ছেড়ে দিতে হবে।” তাই শুনে, অভয় এমন রক্ত চক্ষু নিয়ে অটো চালকের দিকে চেয়ে রইলো, দেখলে যে কারুরই শরীরের সব রক্ত জল হয়ে যায়! খুব ঠান্ডা গলায় অভয় লোকটিকে বললো, “আগের বারের থাপ্পড়টা মনে হয় তুই ভুলে গেছিস, তাই না?!” সেই শুনে, চালক তো আর কোনো ট্যা-ফুঁ না করে, মুখ গুঁজে অটো চালাতে লাগলো।

বেশ বুঝতে পারছিলাম, বিষয়টা গম্ভীর হয়ে উঠছে, সব দেখে বুঝে, আমাকে কথার খিলাফ করতেই হলো। পরিস্থিতি সামলাতে, মিষ্টি কথায়, ‘স্বভাবসিদ্ধ গপ্পো জুড়তে’ এক প্রকার বাধ্যই হলাম! শোভনের হাতটা চেপে ধরে রেখে বললাম, “আর একটু খুলে বলুন অভয়, দেখুন এটা একটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার, এ নিয়ে নিশ্চই আপনি মজা করছেন না!” 

সে বললো, “আমিও তো তাই বলছি! এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার! সেই কথাটা যদি সবাই আর একটু সিরিয়াসলি নিতো তাহলে আমি আরো ক’দিন ভালো ভাবে বাঁচতে পারতাম, জানেন!” ওর গলার স্বরে যেন একটা করুন আর্তি বেরিয়ে এলো এতক্ষন পর! ততক্ষনে, কেন জানিনা অনেকটা ভয় কেটে গেছে আমাদের। অভয় বলতে লাগলো, “এই জন্মে আমি পেশায় একজন গাইড। গতজন্মে, কলেজ ট্রিট এ পড়াশুনার বইয়ের একটা দোকান চালাতাম। দোকানটা ছিল আমার বাবার। নকশাল আমলে আমার বাবা একদিন বোমাবাজির মধ্যে পড়ে যান…” তারপর বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, হঠাৎ বলে উঠলো, “জানেন আমার মৃত্যুটাও আমার বাবার মতন, ওই অপঘাতেই…! কি আশ্চর্যজনক ঘটনা তাই না?!” 

শোভন অনেকক্ষণ চুপ ছিল, এবার খুব সাহস সঞ্চয় করে হঠাৎ বলে বসলো, “হাঃ! আপনি এমন ভাব বললেন, মনে হলো, পর জন্ম নয়, এই জন্মের কথা বলছেন! তা কি ভাবে..  মানে…আপনার মৃত্যুটা কিভাবে…?” 

অভয় চমকে উঠলো কথাটা শুনে! তখন হয়তো সে মনে মনে ওই কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা ধরেই হাঁটছিলো… সম্বিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগলো ওর, তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “ সে বড় যন্ত্রণার! সব কথা তো এখন বলার সময় নেই! তার জন্য তো একটু বেশি সময় লাগবে…ওই দেখুন, আপনাদের হোটেল দেখা যাচ্ছে। কাল ভোরে উঠে, স্যান্ড-ডিউনস দেখতে যাবেন আমার সঙ্গে? আপনারা আমার সব কথা শুনলে, আমি অন্তত একটু শান্তি পাব, জানেন! আপনারা যদি প্রমান চান, আমি তাও দেব!” ছেলেটার চোখে একটা আর্তি লুকিয়েছিল। ওর আন্তরিকতা দেখে, ওকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো! 

জয়সালমের এ এসে থেকেই, স্যান্ড-ডিউন’স যাব কি, যাব না, ঠিক করতে পারছিলাম না, হোটেলের সামনে নির্বিঘ্নে পৌঁছে, পরিবেশটা যেন সেই রাত্রে হঠাৎই খুব ‘থ্রিলিং’ লাগতে লাগলো। এবার ডিসাইড করেই ফেললাম! অভয়কে ভোরবেলা আসতে বলে, অটোর টাকা মেটাতে যাবে শোভন, সে বললো, “কাল সব একবারে হবে!” এই বলে, মুহূর্তের মধ্যে, অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো অটোটা।

ক্ষিদে পেয়েছিলো, সকালে উঠতে হলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুয়ে পড়তে হবে, তাই ঘরে না ঢুকে, ছাদের রেস্টুরেন্ট’টাতে গিয়ে বসলাম আমরা। আমাদের চেনা বাঙালি ওয়েটারকে ইশারা করতেই, সে এসে হাজির হলো। তাড়াতাড়ি কিছু খাবার অর্ডার দিলাম আর পরের দিনের জন্য স্যান্ডউইচ প্যাক করার কথাও জানালাম। ওয়েটার শুনে জানতে চাইলো, ‘কোথায় যাচ্ছি?’ হোটেলের ঠিক করে দেওয়া এজেন্সীর সাথে যাচ্ছি কিনা? সব শুনে, আমতা আমতা করে বললো, “কি দরকার বাচ্চা নিয়ে!?” শোভন একটু ধমকে বললো, “তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো স্পষ্ট করে বলো!” ছেলেটি, “পরে বলছি” বলে, কোনো কাজের অছিলায় দেখলাম কেটে পড়লো।

দূর থেকে আলোকিত দুর্গ দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো। ‘লাল মাস’ খেতে খেতে আর রেস্টুরেন্টের আয়োজিত মজলিসের গান শুনতে শুনতে দুর্গের শোভা, জব্বর লাগছিলো। এই মনোমুগ্ধকর আবেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলোনা। অনেকটা রাত গড়িয়ে গেলো। ভিড় একটু খালি হতেই, ওয়েটারটিকে আবার ডেকে পাঠালাম। 

ওয়েটারকে এবার সরাসরি অভয়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে সে, বললো, “অভয়ের সাথে স্যান্ড-ডিউনসে গিয়ে অনেকেই বিপদে পড়েছেন। ওর খুব মারাত্মক ডিপ্রেশন এর রোগ আছে। মাঝে মাঝে ও যেন, এক অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। তাই হোটেলের সঙ্গে যুক্ত কাউকে বেছে নেওয়াই শ্রেয়।”

আমরাও আলোচনা করে ঠিক করে ফেললাম, যদিও ওয়েটারটি হোটেলের শেখানো কথাই বলছে, তবু আমাদের ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে ‘চান্স’ নেওয়াটা হয়তো একটু বেহিসেবি কাজ হয়ে যাবে। ঠিক করলাম, পরদিন, অভয় এলে কিছু টাকা দিয়ে তাকে, ‘না’ করে দেব। তারপর যদি ও বেশি পীড়াপীড়ি করে তখন দেখা যাবে…

কিন্তু সকালে অভয় এলো না। বেলা গড়িয়ে যেতে, ওয়েটার বললো, “অভয়ের ব্যাপারে আমি যা জানতাম আপনাদের বলেছি, তার থেকে বেশি তো আমি বলতে পারবোনা! আপনারা বরং ম্যানেজারের সাথে কথা বলুন, ম্যানেজার আত্মারাম এখানকার লোকাল, ও হয়ত জানবে!” 

কি আর করা! ও এসেছিলো কি না সঠিক জানতে, ম্যানেজারের কেবিনে যাওয়া হলো। অভয়ের কে চেনে কি না, প্রশ্ন করতেই, ম্যানেজার আত্মারাম জানালো, অভয় আগে ওদের সাথেও কাজ করতো। তারপর অনেক কমপ্লেইন্ট’স আসাতে, ওরা অভয়ের সাথে কাজ বন্ধ করে দেয়। আমরা যতটুকু জানি, তা আত্মারামকে বলতেই, সে বললো, “হ্যাঁ, ওর প্রব্লেমটা তো এটাই! ও যখনি সবাইকে বলে, ও একজন ‘জাতিস্মর’, কেউই তা বিশ্বাস করে না, আর তাতেই ও খুব রেগে যায়! রাগের মাথায় কি যে করে বসে…! এই অবিশ্বাসের জ্বালায়, অভয় বেশ কিছু বছর ধরে ডিপ্রেশনেও ভুগতে শুরু করেছে। ওর মধ্যে মাঝে মাঝে দ্বৈত সত্তা দেখা দেয়। এতে, এখন তার গাইডের ব্যবসারও প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে।”

সব শুনে, শোভন বললো, “হুম, স্প্লিট-পার্সোনালিটি! আমাদের প্রথম থেকেই একটা গোলমাল বোধ হচ্ছিলো! তাই হয়তো সে বেপরোয়া ভাবে আজ ডিউটিতে এলোনা!” ম্যানেজার আত্মারাম বললো, “আমি তাও স্যান্ড-ডিউন’স এর ওখানে একটা খবর নিয়ে দেখছি।” ফোনে কথা বলতে বলতে, “হঁ, হঁ”, করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, চিৎকার করে আত্মারাম বললো, “কি বলছো তুমি?” তারপর শোভনের দিকে তাকিয়ে, ওই শীতের সকালে ঘাম মুছতে মুছতে বললো, “বাবুজি অভয় কি করে আসবে? গত..গত পরশু রাতে, স্যান্ড-ডিউন’সেই সে আত্মঘাতী হয়েছে! হায়, হায়, অর্থের অনটনে, অভাবের তাড়নায়, এবং মানুষের অবিশ্বাসে, কোমরের ছুরির সাহায্যে সে এমন কাজ করে বসলো। কোনো কারণে, কাল সারাদিন তার বডি পাওয়া যায়নি, মরুভূমির মধ্যে আজই সকালে তার বডি উদ্ধার করা হয়েছে!!!!” 

শরীরটা খুব খারাপ লাগছিলো, চারপাশের সব আলো আর শব্দ যেন ক্ষীণ হয়ে আসছিলো, কানে একটা ভোঁ লেগে যাবার মতন! ওয়েটারটি হলদি দেওয়া গরম দুধ এগিয়ে দিলো আমাদের দিকে। পরের দিন আমাদের বিকানের যাবার প্ল্যান ছিল, শোভন দেখলাম আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, তখনই হোটেলের বিল মিটিয়ে, গাড়িটা ধুয়ে রেডি করতে বলে দিলো। আমিও কথা না বাড়িয়ে, শীর্ষাকে তৈরী করে, নিজে তৈরী হয়ে নিলাম। থেকে থেকে শিউরে উঠছিলাম, মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি, শোভন একটাও কথা না বলে মাইলের পর মাইল শুধু গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে।

ধু ধু করে গাড়িটা ছুটছে, রামদেওরার পথে অনেকটা রাস্তা শুধুই কাঁটা ঝোপ, রাস্তা এক্কেবারে ‘সুনসান’! উল্টো দিক থেকেও, একটাও গাড়ির দেখা নেই, নীরবতায় কেটে গেলো আমাদের সফর, পোখরান পর্যন্ত। 

শীর্ষার ক্ষিদে পেতে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম যেন। এবার কোথাও একটা থামতে হবে! পোখরান ফোর্টে, সঙ্গে আনা খিচুড়ি গরম করে খাওলাম দেড়-বছরের শীর্ষাকে। পেট ভর্তি করে সে একেবারে দিলখুশ! এবার পেছনের child seat এ বসে, আপন মনে, সেই বারবেলায় গান ধরলো, “ঘুম যায় ওই সাদ (চাঁদ) মেঘ পরীদের সাথে, গল্প শোনার পালা এখন, নিঝুম-নিশি রা-আতে…” 

সুদীর্ঘ সফরে কত কি যে ঘটে, তার কিছুটা ব্যাখ্যাতীত থেকে যায়। তা, সে জীবনেরই হোক, বা ভ্রমনের…!!!

লেখিকা পরিচিতি

লেখিকা- সুদেষ্ণা মজুমদার, জন্মস্থান কলকাতা। বর্তমানে চেন্নাই নিবাসী। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং জন সংযোগে  স্নাতকোত্তর পড়াশুনা করার পর, সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠানে যোগদান। পরবর্তীকালে, বহু জাতিক সংস্থায় প্রশিক্ষণ বিভাগে দীর্ঘ সময় কাজ করার পর, বর্তমানে একজন শখের চিত্র গ্রাহক এবং লেখিকা।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!