Home সামাজিক, গল্প এমনটাও হয়!
সামাজিকগল্প

এমনটাও হয়!

গোপা মিত্র

শ্বশুরমশাইয়ের চেঁচামেচির ধাক্কাটা কানে বাজতেই ঘুমটা ভেঙে গেল মল্লিকার। পাশে রাখা মোবাইলের ঘড়িতে দেখল সবেমাত্র পৌনে পাঁচটা বেজেছে, এখনও পুরোপুরি সকাল হয় নি, এখন থেকেই উনি শাশুড়িমা’র উপরে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। আজ মল্লিকাদের ছুটি। পাশে শুয়ে তখনও ঘুমচ্ছে তার স্বামী শুভ, আর ছেলে দিব্য। মল্লিকা একবার তাদের দিকে দেখে নিয়ে আবার পাশ ফিরে শুল। বিয়ে হয়ে ইস্তক এই চেঁচামেচি শুনে আসছে সে। তার ছেলের বয়স এখন ছয়। শ্বশুরমশাই বা শাশুড়ি মায়ের বয়সও বেড়েছে, কিন্তু তাহলে কি হবে, তাদের কোনো বদল এখনও হল না। রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী শ্বশুরমশাই রিটায়ার করেছেন প্রায় বারো বছর হল, কিন্তু অধস্তন কর্মচারীদের ওপর চিৎকারের অভ্যাসটা এখনও বজায় রেখেছেন, শাশুড়ি মায়ের ওপর হম্বি তম্বি করে। “সার্টের বোতামটা ছিঁড়ে গেছে, সেলাই করে রাখতে পারনি, এখন পার্কের বন্ধুদের কাছে যেতে যেতেই তো সন্ধ্যা নেমে যাবে, এখানেই তো ছিল রুমালটা- গেল কোথায় সেটা, এটা কি রান্না হয়েছে- ঝোল না কি হলুদগোলা জলের মধ্যে মাছ ভাসছে, আজ মনে হয় রান্নায় নুনও দেওয়া হয় নি, এটা কি ডালের চাটনি হয়েছে নাকি, একেবারে মুখে তোলা যাচ্ছে না, সারাজীবন তো শুয়ে বসে আর হাতা খুন্তি নেড়েই কাটিয়ে দিলে, সামান্য একটু রান্নাও কি ঠিকমত করতে পার না? অফিসে তো আর কোনোদিন কাজ করলে না, বুঝবে কি করে যে কত ধানে কত চাল”! শাশুড়িমায়েরও তো বয়স বেড়েছে, নানারকম ব্যথা বেদনায় কাবু, তবুও সংসারের হালটা যে তিনিই ধরে রেখেছেন সেকথা শ্বশুরমশাই আর বুঝবেন কবে! উনি তো ইচ্ছে হলেই বিছানায় শুয়ে পড়বেন, কিন্তু শাশুড়ি মায়ের কি সে উপায় আছে? দুপুরবেলা স্কুল ছুটির পর পুল কার নামিয়ে দিলে মোড়ের মাথা থেকে নাতিকে নিয়ে এসে তার জামা কাপড় বদলে তাকে খাইয়েদাইয়ে তবেই তিনি একটু বিশ্রাম পান। কিন্তু কতক্ষণই বা, পাঁচটা বাজার আগেই তো উঠে পড়তে হয়, শ্বশুরমশাই এর চায়ের জন্য, তারপর ভাবতে হয় আজকের জলখাবার কি হবে, লুচি পরোটা ঘুগনি হালুয়া নাকি অন্য কিছু! মল্লিকা এসে গেলেও সেগুলোর ব্যবস্থাও তো তাকেই করে রাখতে হয়! না, অনেক হয়েছে আর নয়, মল্লিকাকেই এর একটা বিহিত করতে হবে, এমনটা আর কিছুতেই চলতে দেওয়া যাবে না। কাল সকালেই মল্লিকা নিশ্চিত একটা রাস্তা খুঁজে বার করবে। নির্বিরোধী ভালোমানুষ মা কে বলে কোনো লাভ নেই, শ্বশুরমশাইএর ওপর উনি কোনো কথা বলবেন না। 

সকাল বেলার চায়ের দায়িত্ব মল্লিকার। আজ ছুটির দিন, তাই মল্লিকা টেবিলে সকলের জন্য চা দিল যখন, তখন সাতটা বেজেছে। অন্যান্য দিন অবশ্য সে সাড়ে ছটার মধ্যেই চা দিয়ে দেয়। তারপর চা খেয়ে স্নান করতে চলে যায়। আজ তাড়া নেই, তাই একটু দেরীতেই চা করেছে। শ্বশুরমশাই মর্ণিং ওয়াক থেকে ফিরে এসেছেন, শাশুড়িমাও স্নান সেরে নিত্য পূজো শেষে টেবিলে এসে বসেছেন। শুভ আর দিব্যকে তুলে দিয়ে, দিব্যর দুধটা নিয়ে এসে সেও বসে গেল তাদের সঙ্গে। একটু পরেই শুভ দিব্যকে তৈরী করিয়ে এসে যোগ দিল তাদের সঙ্গে। চা খেতে খেতে সে সেদিনের কাগজটায় চোখ বুলোতে লাগল, আর মল্লিকা চলে গেল স্নান সারতে। 

আজ ছুটি, তাই আজ ব্রেকফাষ্টে জ্যাম বা মাখন পাঁউরুটি ডিম নয়, আলুর তরকারী বা কোনো ভাজার সঙ্গে লুচি খাওয়া হবে। স্নান সেরে রান্নাঘরে এসে মল্লিকা দেখল, শাশুড়িমায়ের তরকারী নামান হয়ে গেছে, ময়দাও মেখে ফেলেছেন। সে এসে বেলে দিলে তাড়াতাড়ি লুচিগুলো ভেজে নিয়ে শাশুড়িমা টেবিলে সেগুলো পরিবেশন করে দিলেন। লুচি পেয়ে দিব্যও খুব খুশী। মল্লিকা আর শাশুড়িমায়েরও খাওয়া হয়ে গেল। এবার সকালের রান্নার ব্যবস্থা। 

ছুটির দিনে এবাড়ীতে সকালে মাটন বা চিকেন হয়। মল্লিকা দেখল আজ মাটন এসেছে। শ্বশুরমশাইয়ের কড়া হকুম, প্রেসার কুকারে সেদ্ধ করে রান্না করলে চলবে না, তাতে নাকি রান্নার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। কষে না করলে কি মাংসর স্বাদ পাওয়া যায়! শুধু মাংসই বা কেন, কোনো রান্নাই সেদ্ধ করে করা চলবে না, আগের দিনে মা ঠাকুমারা যেমন করে করতেন তেমন করেই করতে হবে, তবেই তো রান্না স্বাদিষ্ট হবে! তার ধারণা, মায়ের আর কাজ কি, সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটান, রান্নাটুকুও ঠিক মত করতে পারবেন না! তবু ভালো, বাটনা বাটা থেকে মাকে রেহাই দিয়েছেন!

আজ মল্লিকা থাকাতে মায়ের একটু সুবিধাই হল, হাতে হাতে সে মাকে সাহায্য করতে পারল। শুধু তো সকালের রান্নাই নয়, বিকেলের জলখাবার, রাতের রুটির জন্যও তো দুটো তরকারী করতে হবে! মল্লিকা মাকে জিজ্ঞেস করল যে, সকালে তো লুচি হয়েছে, বিকেলে কি হবে। মা বললেন যে, মটর সেদ্ধ করে রেখেছি, বিকেলে ঘুগনি করব ভেবেছি। রাতেও কোন্‌ দুটো তরকারী হবে মা বলে দিলে, মল্লিকা চট্‌পট কেটেকুটে ঠিক করে মায়ের হাতের কাছে এগিয়ে দিল। শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশ সারা সপ্তাহ মল্লিকা স্কুল করে, কাজেই ছুটির দিনে সে একটু বিশ্রাম নেবে, কোনোরকম রান্নায় হাত দেবে না।


রাত প্রায় দশটা বাজে। সারদিনের পরিশ্রমের পর, রোজকার মত আজও প্রতিমা, মল্লিকার শাশুড়িমা, এবার এসে বসেছেন টিভির সামনে, ঘন্টাখানেক নিজের পছন্দমত সিরিয়াল দেখে তারপর শুতে যাবেন তিনি। সন্ধ্যেবেলায় তো টিভির রিমোট হাতে পাওয়ার জো নেই –বাবা ছেলে তখন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাজ্যের খেলা দেখে বেড়ায়। মল্লিকা এসে বসল পাশে। “মা আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল”। “হ্যাঁ বল বৌমা, আজ তোমার খাতা দেখা নেই”? “না মা, দিব্য ঘুমিয়ে পড়েছে, শুভও একটা ইংরাজী পেপারব্যাক বই পড়ছে, বাবাও ঘুমোচ্ছেন, এছাড়া সারাদিনে আর তো বলার সময় পাব না, তাই আপনার টিভি দেখায় ডিষ্টার্ব হলেও এখনই আমাকে আসতে হল। আচ্ছা মা, আজ সকালে বাবা অত রাগারাগি করছিলেন কেন? কি হয়েছিল”? “আর বোলো না বৌমা, কাল রাতে বাতের ব্যথাটা খুব বেড়ে ছিল, তাই ভালো ঘুম হয় নি। ভোরের দিকে দু চোখের পাতাটা একটু লেগে গিয়েছিল, লেবু মধুর জলটা করা হয় নি, তাই আর কি! এই নিয়ে তুমি ভেব না বৌমা, সারাটা জীবন তো এই চেঁচামেচি শুনেই কাটিয়ে দিলাম, ও আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমি বল, কি বলতে এসেছ”? “না, মা এমনটা আর চলতে পারে না। শুভকেও দেখছেন তো, দিনে দিনে একেবারে বাবার মতই হচ্ছে। একই সঙ্গে আমরা স্কুলে যাই, ফিরিও একই সঙ্গে, অথচ ফিরে এসেই রেডী হয়ে চা জলখাবারের অর্ডার দিয়ে শুভ বসে যায় টিভি দেখতে। আর আমি? দিব্যকে খাইয়েদাইয়ে তাকে নিয়ে পড়াতে বসতে হয়। তারপর রাত জেগে চলে আমার খাতা দেখা। শুভ যদি দিব্যকে নিয়ে একটু বসত আমি তো আপনাকে একটু সাহায্যও যেমন করতে পারতাম, তেমন রাত জেগে খাতাও দেখতে হত না! কিন্তু তা কেন করবেন শুভ – উনি ছেলে না, এসব তো বাড়ীর মা বৌদের কাজ! বাড়ীতে হাতা খুন্তি নাড়ার সঙ্গে সংসারের খুঁটিনাটির দিকে লক্ষ্য রাখা আর ছেলেমেয়ে মানুষ করাটাও যে কাজের মধ্যেই পড়ে এগুলো আর ছেলেরা বুঝবে কবে! আমি ঠিক করেছি এবার সেটা তাদের বুঝিয়েই ছাড়ব। এজন্য আপনার সাহায্য লাগবে আমার”। “হ্যাঁ বৌমা বল, আমাকে কি করতে হবে – যদি আমার পক্ষে করা সম্ভব হয় আমি নিশ্চয় তোমার সঙ্গে থাকব। তবে এমন কিছু কোরো না, যাতে তোমার বাবা তোমাকে ভুল বুঝে তোমার ওপর ক্ষুব্ধ হন, জানো তো উনি তোমায় কতটা ভালোবাসেন”! “শুধু উনি কেন – আপনিও যে আমাকে কত ভালোবাসেন, আমি জানি। তাই তো আপনার ওপর যখন বাবা চেঁচামেচি করেন, আমার খুব খারাপ লাগে। আমি একটা উপায় ভেবেছি, সেইটা ঠিকঠাক যদি করা যায়, তাহলে এই সব কিছুই বন্ধ করা যাবে। এখন শুনুন আমি কি ভেবেছি”।

সব শুনে, প্রতিমা বললেন “বৌমা, প্রস্তাবটা একটু বিপজ্জনক নয় কি! যদি তুমি বা আমি ধরা পড়ে যাই আমরা দুজনেই ওদের, বাবা ছেলের চোখে, কতটা ছোটো হয়ে যাব, বুঝতে পারছ? তুমি পারলেও, এই বয়সে এসে আমি কি অভিনয়টা ঠিকমত করতে পারব? ধরা পড়ে গেলে কি হবে বলতো”? “কিচ্ছু হবে না মা। আজ ডাক্তার জ্যাঠার সঙ্গেও কথা বলে এসেছি, উনিও আমাদের সাহায্য করবেন বলেছেন। আপনি শুধু সাহস করে রাজী হয়ে যান, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে”। “বেশ, তুমি যখন বলছ, আমি রাজী। সব দায়িত্ব কিন্তু তোমার”। “ঠিক আছে তাই হবে মা। আর একটা কথা আমি এতদিন বলিনি আপনাকে মা, আজ বলছি আপনাকে –তিন চার দিনের ছুটি থাকলেই শুভ আমাদের নিয়ে কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে যেতে চায়, কিন্তু আমি আপনাকে এই কাজের মধ্যে একলা ফেলে রেখে কোত্থাও যেতে চাই না। শুভ রেগে যায়, তবুও। এমন চলতে থাকলে আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরী হবে, তখন হয়তঃ আমাদের সম্পর্কটা আর ধরে রাখাও যাবে না। তাই আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই”। এই বলে উঠে গেল মল্লিকা।


পরদিন ভোরবেলায় শ্বশুরমশাইয়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল শুভ আর মল্লিকার। শ্বশুরমশাই তাদের দুজনের নাম ধরে ডাকছেন আর বলছেন, শুভ শিগ্‌গির এসে দেখ্‌ তোর মা উঠতে পারছে না, বৌমা এসে দেখ, তোমাদের মায়ের কি হল”! তারা এসে দেখল মা খাটের পাশে আলুথালু হয়ে বসে আছেন। তাড়াতাড়ি দুজনে ধরাধরি করে মাকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছিল মা, তুমি পড়ে গেলে কি করে”! প্রতিমা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “অত চিন্তার কিছু নেই। কাল রাত থেকেই আমার বুকটা কেমন ধড়ফড় করছিল, রাতে ভালো ঘুমও হয়নি, তবুও সকালে উঠে বাথরুম সেরে, এগোতে গিয়েই কেমন করে যেন বসে পড়লাম, তারপর দেখি আর উঠতেই পারছি না, বুকটাও কেমন যেন ব্যথা করছে। তোমরা চিন্তা কোরো না, একটু শুয়ে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে”। “তা বললে কি হয় মা, আপনার বয়স হয়েছে, একবার তো ডাক্তার জ্যাঠাকে ডাকতেই হবে”, বলে উঠল মল্লিকা। সায় দিয়ে উঠল শুভ আর শুভর বাবা। 

তাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার জ্যাঠা পাড়াতেই থাকেন, শ্বশুরমশাইএর বন্ধু। খবর পেয়ে তিনি এসে পড়লেন। তারপর সবকিছু শুনে প্রতিমাকে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, “শিবু”, শ্বশুরমশাইএর ভালো নাম শিবেন্দু, “লক্ষণ তো সুবিধার মনে হচ্ছে না। বৌমার, কদিন একেবারেই বিছানা থেকে ওঠা চলবে না, বাথরুমে গেলেও সঙ্গে একজনকে থাকতে হবে, নচেৎ বেডপ্যান ব্যবহার করতে হবে। কদিন একেবারে বেডরেষ্টে থাকার পরও যদি বুকে আবার ব্যথা হয়, তবে একবার ই সি জি করতে হবে, ততদিন পর্যন্ত আমি কতগুলো ভিটামিন ট্যবলেট আর অ্যানিমিয়ার ওষুধ দিয়ে গেলাম, সেগুলোই বরং নিয়ম করে খাক। দশদিন পরেও যদি উপসর্গগুলো থাকে ই সি জি করতে বলব”। মল্লিকা বলে উঠল, “কিন্তু ডাক্তার জ্যাঠা, মা’ কে ছাড়া চলবে কি করে – মা’ই তো রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সংসারের সব কিছু সামলায়। আজ আমার ছুটি আছে, আজকের দিনটা আমি না হয় সামলে দেব, কিন্তু কাল থেকে কি হবে? আমিও তো আর ছুটি পাব না। আবার পরশু থেকে আমার ইলেকসান্‌ ডিউটি পড়েছে, সুন্দরবনের এক গ্রামে, সেখানে আমাকে যেতেই হবে, দিন তিনেকের জন্যে। শুভ, বাবা মায়ের দোহাই দিয়ে যাবে না বলে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে। কিন্তু দুজনে তো আর একই সঙ্গে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। সব দিক বিবেচনা করে আমার মনে হচ্ছে আমি বরং চাকরীটা ছেড়েই দিই। তাহলে আর কোন সমস্যা হবে না”। তার কথা শেষ হবার আগেই শ্বশুরমশাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন “তোমার এমন স্থায়ী চাকরীটা তুমি ছেড়ে দেবে বৌমা! শুভ আর তুমি একসঙ্গে যাও, আসো, এমন কিছু দূরেও নয় স্কুল, এমন ভালো চাকরীটা তুমি ছেড়ে দেবে ভাবছ? না না, তা হয় না। শুভ আর আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। ভারী তো রান্না, ও আমরা ঠিকই করে নিতে পারব। কি রে শুভ, পারব না”? “না পারার কি আছে, এখন তো ইউটিউব খুললেই কতরকম রান্না দেখা যায়। দেখবে দেখবে, কত রকম রান্না করে খাওয়াব তোমাদের” শুভ বলল। “তা না হয় হল, কিন্তু মা’র সঙ্গে সারাদিন থাকবেটা কে”? মল্লিকা বলল। “সে চিন্তা কোরো না তুমি, আমার পরিচিত বিশ্বাসী একটি মেয়েকে আমি নাহয় পাঠিয় দেব, সেই সারাদিন বৌমার সঙ্গে থাকবে”। ডাক্তার জ্যাঠা বললেন। ব্যস সব কিছু ব্যবস্থা করে উনি চলে গেলেন। 


বসার ঘরের ডিভানে মায়ের শোয়ার ব্যবস্থা হল। ঝর্ণা, ডাক্তারবাবুর পাঠানো মেয়েটিও এসে গেল। মায়ের ঘরেই তার শোয়া বসার ব্যবস্থা হল, তার কাজও তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। ইতিমধ্যে সকালের জলখাবার, মাখন পাঁউরুটি ডিম কলা সবার খাওয়া হয়ে গেল। ছুটির দিন হলেও আজ আর কেউ লুচির বায়না করল না। 

মল্লিকা এবার রান্নাঘরে ঢুকল, শুভকে সঙ্গে নিয়ে। কোথায় কি রাখা আছে তাকে সব দেখিয়ে দিয়ে, রান্না শুরু করল। শুভ পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে লাগল, কেমন করে ভাত রাঁধতে হয়, প্রেসার কুকার ব্যবহার করতে হয়, মাছ ভাজতে হয়, তরকারী রান্না করতে হয় – সবই মল্লিকার সঙ্গে থেকে শুভ বুঝে নিতে চাইল। রাতেও রুটি করা দেখিয়ে দিয়ে, মল্লিকা শুভকে বলল যে, অসুবিধা হলে পাড়ার দোকান থেকে অনায়াসেই রুটি কিনে আনতে পারবে। যাহোক্‌ আজকের দিনটা কোনোক্রমে মল্লিকা ম্যানেজ করে দিল। 

পরদিন রোজকার মতই সকালে উঠে স্নান সেরে মল্লিকা আবার রান্নাঘরে ঢুকলো। তার আগে অবশ্য শ্বশুরমশাই শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে ঝর্ণাকেও জলখাবার দিয়ে দিয়েছে। দিব্যকে দুধ আর ক্রীম বিস্কুট খাইয়ে, তাকে তৈরী করে, টিফিন দিয়ে তাকে পুলকারে তুলে দিয়ে এসেছে শুভ। মল্লিকা ততক্ষণে নিজেদের টিফিন গুছিয়ে নিয়েছে। তারপর খেতে বসেছে, শুভর সঙ্গে – ডাল, ভাত আলুসেদ্ধ উচ্ছে চচ্চড়ি আর মাছের ঝোল দিয়ে। বেরোবার আগে আবার একবার সবকিছু ঝর্ণা আর শ্বশুরমশাইকে বুঝিয়ে দিয়ে মল্লিকা স্কুলের দিকে রওনা দিল শুভর সঙ্গে।

বিকেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে, শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে সবাইকেই চা জলখাবার দিয়ে দিল মল্লিকা। কেনা খাবার শ্বশুরমশাই পছন্দ না করলেও সময় স্বল্পতা হেতু আজ সে ফেরার সময় সকলের জন্য কচুরি তরকারী কিনে এনেছিল। শ্বশুরমশাই অবশ্য আজ আর কিছু বললেন না। রাতের জন্য একটা তরকারী আর রুটি করে এসে মল্লিকা পরের দিনের যাবার প্রস্তুতিতে লেগে গেল।


তিনদিন পর আজ বাড়ী ফিরল মল্লিকা। আজ শনিবার স্কুল হাফ ডে। মল্লিকার অবশ্য আজকের দিনটাও ছুটি রয়েছে। শুভ স্কুলে বেরিয়ে গেছে। ফিরেই মল্লিকা আগে গেল মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। দেখল মা বসে বসে টিভি দেখছেন, সঙ্গে রয়েছে ঝর্ণা। ওকে দেখে মা, খুশি হয়ে বললেন, “কেমন আছ বৌমা? শরীর ঠিক আছে তো? যাও আগে গিয়ে স্নান সেরে মুখে কিছু দাও, নিশ্চয় খুব ভোরে বেরিয়েছ, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত হয় নি! তবে যাওয়ার আজে তোমার শ্বশুর মশায়ের সঙ্গে একবার দেখা করে যাও”। মল্লিকা বলল “হ্যাঁ মা, যাচ্ছি” বলে চলে গেল শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দিকে।

শ্বশুরমশাই শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছিলেন। মল্লিকাকে দেখে উঠে বসলেন। কুশল প্রশ্নাদির পরে তিনি বললেন “সত্যি বৌমা, রান্নাবান্না, সংসার সামলানো যে এমন এক ঝক্‌মারীর কাজ, না করলে বুঝতেই পারতাম না। কি করে তোমরা মেয়েরা যে এত দিক সামলাও কে জানে! তোমার মা চাকরী করেন না বলে তাকে আমি এতদিন অনেক কথা শুনিয়েছি। এখন বুঝতে পারছি, মাথা ঠান্ডা রেখে সেই ভোরবেলা থেকে উঠে তিনি কতদিক সামলেছেন। সামলেছেন বলছিই বা কেন এই বয়সে এসে আমি তো রিটায়ারমেন্ট নিয়ে ঘরে বসে আছি, তিনি কিন্তু এখনও মুখ বুজে নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। না আর নয়, বুঝতে পারছি, এবার ওনারও বিশ্রামের দরকার। শুভ ফিরলে দেখি, তোমার মায়ের জন্য কি করা যায়”! 

শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে ঢুকেই মল্লিকার নজর পড়েছিল উল্টোদিকের দেওয়ালে লাগানো বড় টিভিটার দিকে। এতক্ষণ শ্বশুরমশাই কথা বলছিলেন বলে, কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। এবার প্রশ্ন করল “বাবা নতুন টিভি কিনলেন বুঝি”? “হ্যাঁ সন্ধ্যাবেলায় টিভি দেখার অসুবিধা হচ্ছিল বলে শুভ কিনে এনেছে। সময় করে দেখো, খুব ভালো ছবি আসে, স্মার্ট টিভি- ও টি টি তেও অনেক কিছু দেখা যায়। শুভই লোক নিয়ে এসে সব ব্যবস্থা করেছে”। 

এবার মল্লিকা এসে উপস্থিত হল রান্নাঘরে। রান্নাঘরের অবস্থা দেখে মল্লিকার কান্না পাওয়ার অবস্থা। এখানে সেখানে রান্নার বাসনগুলো গোঁজা রয়েছে, মশলাপাতি সব তাক থেকে নামিয়ে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু তার মধ্যেই নজর কাড়ল নতুন এক রাইস কুকার। যাক্‌ ভালোই হল কষ্ট করে আর মাকে ফেন গেলে ভাত করতে হবে না। যতটা পারে ঘরটা গুছিয়ে রেখে মল্লিকা স্নান সেরে আবার এসে বসল মায়ের কাছে। বলল “মা দেখলাম নতুন টিভি এসেছে, তোমায় আর রাত জেগে সিরিয়াল দেখতে হবে না। দেখলাম রাইস কুকার এসেছে, তোমায় আর নিচু হয়ে বসে ফেন গালতে হবে না”। “যা বলেছ বৌমা, সন্ধ্যেবেলা বাবা ছেলে বসে খেলা দেখতে পারছিল না, টিভি যে রয়েছে এঘরে, তাই চলে এলো টিভি। ভাত রান্না করতে গিয়ে একদিন বেশীর ভাগটাই তো পড়ে গেল, আর একদিন তো গলে পাঁক হয়ে গেল,তাই চলে এলো রাইস কুকার। আর তোমাদের ঐ ইউ টিভি না কি বলে, তাই দেখে শুভ একদিন কুকারে ভাত রান্না করেও ফেলল। যা হোক্‌ তা হোক্‌ করে বাবা ছেলে মিলে ডাল তরকারি করছিল বটে, তবে রুটি কিন্তু রোজ কেনাই হয়েছে”। 

আজ অবশ্য মল্লিকা রুটি তরকারি নিজেই করেছে, তারপর ঝর্ণার হাত দিয়ে মা’র কাছে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে একসঙ্গে খেতে বসেছে তিনজনে। কথা শুরু করলেন শ্বশুরমশাই, “বৌমা, আমার মনে হয় তোমার মা সুস্থ হয়ে উঠলেও, রান্নার এই ভারী দায়িত্ব আর নেওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। উনি বরং বাকী সব হাল্কা কাজগুলো যতটা পারেন করুন, আমরাও না হয় সাহায্য করব। এবার বরং তুমি একটা রান্নার লোক ঠিক কর, সেই এসে রান্না করে দিয়ে যাক্‌। কি বলিস শুভ”? “কিন্তু বাবা, সে কি আর মায়ের মত রান্না করতে পারবে? সে রান্না কি আর আপনারা মুখে তুলতে পারবেন” মল্লিকা বলল। “পারব বৌমা, নিশ্চয় পারব। তুমি রইলে, তোমার মা’ও রইলেন, তোমরা না হয় একটু দেখিয়ে শুনিয়ে, শিখিয়ে পড়িয়ে নিও। প্রথমে হয়তঃ একটু অসুবিধা হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ততদিনে তোমার মা’ও নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবেন”।

খাওয়া শেষে মল্লিকা চলল মা’কে সুখবরটা দিতে। এক্ষুনি মা’কে গিয়ে বলতে হবে, মা আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে, এই বয়সে আপনাকে আর দুবেলা কষ্ট করে রান্না করতে হবে না, বাবাও আর আপনার ওপর রাগ দেখিয়ে চেঁচামেচি করবেন না, শুধুমাত্র অফিসের কাজটাই যে কাজ নয়, বাড়ীতে থাকলেও মেয়েদের যে বাড়ীতে কতদিক সামলাতে হয়, যার জন্য ছেলেরা নির্বিঘ্নে অফিসে কাজ করতে পারে, সেটা বাবা, ছেলে দুজনেই বুঝতে পেরেছে, আর আপনাকে হীনম্মন্যতায় ভুগতে হবে না, অফিসে কাজ করেন না বলে আর কেউ আপনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না।

~ সমাপ্ত ~
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে।simplistic plot কিন্তু লিখেছো ভালো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!