শ্রাবণী চ্যাটার্জি
(এই কাহিনীর সকল চরিত্র, স্থান, কাল এবং বিষয়বস্তু কাল্পনিক, বাস্তবের সঙ্গে ঘটনার কোনও যোগসূত্র নেই। যদি কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তি অথবা ঘটনার সঙ্গে কাহিনীর কোনও মিল পাওয়া যায়, তা নিতান্তই কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত বলে ধরে নিতে হবে।)
~ শেষাংশ ~
মণিদিদা বলতে শুরু করলো…….
তোদের এই বাড়িটা তো সেদিন তৈরি হলো। সব্বাই লোকটাকে বলেছিল, এ জমিটা কিনো না। ভালো হবে না। কিন্তু উনি পুলিশবাবু, তাই কারও কথা শুনলো না। আমরা জন্মে থেকে দেখেছি ওখানে একটা ইট বার করা পুরোনো বাড়ি ছিল। আমার বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছিলাম এই বাড়িতে যে মানুষজন বাস করতো তারা ছিল মুসলিম। তারপর একসময় পড়ে থেকে থেকে এটা পোড়ো বাড়ি হয়ে যায়। মঈনুদ্দিন নামে একটা মাতব্বর গোছের ছোকরা তার দাদুর কাছ থেকে এই বাড়িটা পেয়েছিল। আমরা সবাই হাঁ হয়ে শুনছি মণিদিদার গল্প।
মণিদিদা বলে চললো….
মঈনুদ্দিনের দাদু শাজাহান রোডে থাকতো। তা এই ছোকরা একবার একটা হিঁদু বউকে তুলে এনে এখানে আটকে রেখেছিল। আর তার বরকে খুন করে এখানে কবর দিয়েছিল। হিঁদু বউটাও মঈনুদ্দিনকে খুন করেছিল সেদিনই। আর ওই ইদারা থেকে ঘড়া ঘড়া জল তুলে নাকি সে রক্ত ধুয়েছিল।
গল্প শুনতে শুনতে আমরা হাঁ হয়ে গিয়েছি! মণিদিদা একটু থামলো। শম্পা বললো তারপর মণিদিদা, তারপর কি হলো….
দিদা বলতে শুরু করলো… তারপর থেকে বাড়িটা পড়েইছিল। আমরা বড় হয়ে দেখেছি যেবার বেগমপুর অঞ্চলে কলেরায় মড়ক লাগলো, সেবার শয়ে শয়ে মড়া নিয়ে এসে এখানে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে এটা কবরখানা হয়ে উঠলো। চারপাশে যাদের বাড়ি তারা সবাই আপত্তি তুলেছিল,আমরা এখানে ছেলেপুলে নিয়ে বাস করি। এখানে কবর দেওয়া চলবে না। কিন্তু কার কথা কে শোনে! পরের পর মৃতদেহ আসতে লাগলো আর কবর খুঁড়ে খুঁড়ে দেহ ঢোকাতে লাগলো। তারপর অনেক অশান্তি হয়ে তবে এখানে কবর দেওয়া বন্ধ হলো। আমরা এতদিন ধরে এখানে এতো বড় হলুম, দেখেছি “তেনারা” মানে ভূত-পেতগুলো কারুর কোনও খেতি করেনি। ওরা নিজেরা নিজেদের মতোই থাকে।
মণিদিদার গল্প শুনে ভয়েতে আমরা কেউ বাড়িতেই আসতে পারছিলাম না। তবে বাড়িতে বলিনি আমরা মণিদিদার কাছে শোনা আমাদের কবরখানার বাড়ির গল্পগুলো। শুনে তো বড়রা সবাই বলবে যত্তসব আষাঢ়ে গল্প! তারউপর হয়তো মনোময়ীদের বাড়িতে যাওয়াই বন্ধ করে দেবে।
তবে আষাঢ়ে গল্প বলে সহজে সব কিছুকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভুত-প্রেত বা আত্মা-প্রেতাত্মা এসব আমিও তেমন বিশ্বাস করি না। কিন্তু ওই বাড়িটাতে এমন কিছু ভয় ধরানো ঘটনা ঘটতো যা বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। আর ঘটনাগুলো বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জানান দিতো যে এই বাড়িতে কিছু ভৌতিক ঘটনা ছিল যার কোনও বিশ্লেষণ হয় না।
নাগপুরে গিয়ে আমার সেজদা তেমন আশানুরূপ কোনও চাকরি না পেয়ে চিঠিতে বাবার অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল দুর্গাপুজোর ক’দিন আগে। আমার সেজদির তখন বাচ্চা হয়েছে। তাই সেজদি আমাদের বাড়িতেই ছিল। একমাত্র পুজোর অষ্টমীর দিনেই সন্ধ্যেবেলা মা ঠাকুর দেখতে বেরোতো। সঙ্গে বাবা আর আমরা যেতাম। সেবার সেজদি আছে বলে মা ঠাকুর দেখতে যেতে চাইছিল না। সেজদা মা’কে বললো তোমরা সবাই ঠাকুর দেখতে যাও। আমি বাড়িতে থাকছি। বাড়ির সব কাজ আমি সামলে নেবো।
সেজদা রান্নাবান্না সেরে সেজদিকে খাইয়ে-দাইয়ে মশারি টাঙিয়ে ওকে শুইয়ে দিয়েছে। সারাদিন বাচ্চার ধকল সামলে সেজদিও ঘুমিয়ে পড়েছে। সেজদা একা অন্যঘরে বসে রেডিও-টিভি সারানোর কাজ করছে। সে সময় চাকরি পাবার আগে, সেজদা এসব কাজই করতো।
হঠাৎ ওর মনে হলো এই বুঝি সিঁড়ি দিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা উঠছি। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখে কেউ নেই তো! মনে মনে বলে ওঃ, তাহলে হয়তো কাজে ব্যস্ত তাই ভুল শুনেছি। বলে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকতেই আবার দল বেঁধে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার শব্দ… আবার দেখে নাঃ, মায়েরা তো কেউ ফেরেনি! এতোবার ভুল শুনলাম! আরো দুবার একই আওয়াজ পেয়ে সেজদিকে গিয়ে ডেকে বলে তুই একটু জেগে থাক তো! বার বার মনে হচ্ছে ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। গিয়ে দেখছি না, কেউ নেই! সেজদি জেগে রইলো। খানিক পরে আমরা সবাই বারুইপুরের কমলা ক্লাব, দত্ত পাড়া, ভাই ভাই সঙ্ঘের ঠাকুর দেখে হৈ হৈ করে ফিরে এলাম। সেবারে ঠাকুর দেখে ফিরতে আমাদের বেশ দেরিই হয়েছিল। এসে সেজদার কাছে ঘটনাটা শুনেছিলাম।
আমার বাবা একটা রিক্সা কিনেছিলেন। এখন যেমন সবাই একটা করে অটো বা টোটো কেনে, তখনকার সময়ে অনেকেই একটা রিক্সা কিনতো। রিক্সাওয়ালা বাবাকে সকালে স্টেশনে দিয়ে আসতো ট্রেন ধরার জন্যে আর সন্ধ্যেবেলা স্টেশন থেকে নিয়ে আসতো। এছাড়া বাড়ির বিভিন্ন প্রয়োজনে রিক্সা লাগতো।
আমাদের রিক্সা চালাতো হারুণ। ওর পুরো নাম হারুণ আল রশিদ। আমি হারুণদা বলতাম। ওখানেই ধারে কাছে তার বাড়ি ছিল। খুব ভালো ছেলে, দরকারে আমাদের বাড়ির ফাইফরমাসও খেটে দিতো হাসি মুখে। কিন্তু বড্ড গরিব। তাই আমার বাবা আমার মা’কে বলে রেখেছিলেন হারুণ রোজ দুপুরে আর রাত্তিরে আমাদের বাড়িতে খাবে। আর আমাদের দিয়ে আসা নিয়ে আসা ছাড়া, সারাদিন ও রিক্সা চালিয়ে যা রোজগার করবে,রাতে খেতে এসে তাই থেকে প্রতিদিন পাঁচ-টাকা করে দিয়ে যাবে। রিক্সাটাও এখানে রেখে যাবে। হারুণদাও তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল।
একদিন সন্ধ্যেবেলা থেকে অবিশ্রান্ত ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। সঙ্গে চারদিক আলোয় যেন ধুয়ে দিচ্ছে এমন বিদ্যুতের চমক! বাপরে! মেঘের গর্জনে খড়খড়িয়ে উঠছে জানলা দরজা। ধারে কাছে বাজ পড়েছে বার দুয়েক। ঝড় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট অফ হয়ে গিয়েছে। দুটো হ্যারিকেন জ্বলছে দুঘরে। জানলা দরজা সব বন্ধ। হাত-পা গুটিয়ে সবাই বসে আছি। বাবা মাকে বললেন রাত বাড়ছে,আজ আর বৃষ্টিও থামবে না, কারেন্টও আসবেনা বলে মনে হয়। তুমি সবাইকে খেতে দিয়ে দাও। মা আক্ষেপ করে বললো, আহাঃ রে! আজ আর হারুণটার খাওয়া হবে না। এত বৃষ্টিতে মনে হয় সে আসতে পারবে না।
হারুণদা রোজ রাতে খেতে এসে সেজদার হাতে রিক্সার দরুন পাওনা টাকাটা দিয়ে যেতো। মা সবে এক এক করে সবার ভাত বাড়ছে, এমন সময় ওই তুমুল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই হারুণ সেজদা সেজদা বলে ডাকতে ডাকতে দোতলায় উঠে আসছিল। হারুণদার ডাক আমরা সবাই শুনেছিলাম। সেজদা তাড়াতাড়ি করে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখে হারুণ একটা রেনকোট পরে উপরে উঠে এসে বলছে, সেজদা টাকাটা দিতে এলাম। সেজদার পিছনে আমিও বেরিয়েছি। সেজদা একটু চমকে গেলো! হারুণদাকে কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগছে! ঠিক হারুণ হারুণ যেন মনে হচ্ছিলো না! একে অন্ধকার তারওপর বৃষ্টির জন্যে সারা শরীর, এমনকি মুখটাও ঢাকা!
হারুণদা পাঁচটাকা সেজদার হাতে দিয়েছিল। হাতে টাকাটা দিতেই সেজদা বললো বাব্বা! সন্ধ্যে থেকে কত ভিজেছিস রে? তোর হাতটা তো একেবারে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে! হারুণদা হালকা হেসেছিল। সেজদা বললো, আয় মা ভাত বাড়ছে। একেবারে দুটো খেয়ে চলে যা। হারুণদা বললো, নাঃ সেজদা আজ আর কিছু খাবো না। চলে যাচ্ছি। সেই মুহূর্তে আমি-সেজদা দুজনেই দেখেছি, বিদ্যুতের আলোয় হারুণদার মুখটা কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। ওদিকে মা ডাকছে কি রে! তোরা এতক্ষণ কি করছিস ভাত ফেলে রেখে!
হারুণদা চলে গেলো। আমরা দরজা বন্ধ করে এসে খেতে বসার আগে সেজদা গিয়ে পাঁচ টাকাটা ঘরে শোকেসের মাথায় উপ রেখে এলো। মা বললো, হারুণটা কেমন ছেলে দেখো! এই ঝড়-বৃষ্টি মাথায় বয়ে নিয়ে কেউ আসে এভাবে! সেজদা যেন কিছু একটা ভাবছিল!
ভোরবেলাতেই ঝড়-বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। হারুণদা সময় মতো এসেছে বাবাকে নিয়ে ষ্টেশনে পৌঁছে দেবে বলে। রিক্সাওয়ালা নয়,হারুণদা আমাদের বাড়িতে একেবারে ঘরের ছেলের মতোই হয়ে গিয়েছিল। আর ওর আচার আচরণ, ব্যবহার অত্যন্ত ভালো বলে আমরা বাড়িশুদ্ধু সবাই ওকে খুব পছন্দ করতাম। আমার বাবা-মাও ওকে খুব ভালোবাসতো।
হারুণদা দোতলায় উঠে এসে সেজদার হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়ে বলেছিল, সেজদা রাগ কোরো না যেন। কাল অত বৃষ্টিতে এসে টাকাটা দিয়ে যেতে পারিনি।
সেজদা বললো, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? কাল তো তুই রাতে এসে আমাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়ে গেলি। বললি, আজ রাতে আর খাবো না। বলে তো চলে গেলি!
হারুণদা বললো, কাল বিকেলবেলা থেকে শরীরটা ভালো ছিল না বলে আমি রিসকা বার করিনি! তারপরই তো যা বেদম বিষ্টি শুরু হলো। তাই আমি আর একটুও বেরোইনি। রাখো টাকাটা। আমিও হতভম্ব হয়ে হারুণদার কথা শুনছি! বলে কি! কাল রাতে আমিও তাকে দেখেছি, সেজদার হাতে পাঁচ টাকা দিতে।
সেজদা একছুটে ঘরে গিয়ে শোকেসের মাথার উপর দেখে টাকাটা নেই! শোকেসের আসেপাশে আঁতিপাতি করে খুঁজেও টাকাটা পাওয়া যায়নি! শোকেসের উপর হাতের ভর দিয়ে সেজদা রাতের কথা ভাবতে লাগলো। হারুণদা ততক্ষণে রিক্সা নিয়ে ষ্টেশনের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিল বাবাকে ৮:০১-এর বারুইপুর লোকাল ধরাতে।
বাড়িটাতে এসব ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার থাকলেও আমার কিন্তু ওই বাড়িটাকে খুব ভালো লেগেছিল।
ওই বাড়িতে ভাড়া আসার পর প্ৰথম প্রথম শম্পাদের সঙ্গে যুক্তি করে অনেক দস্যিপনা করেছি। ছোট থেকেই আমি খুব ডাকাবুকো ছিলাম। ভয়ডর তেমন কিছুই ছিল না। এই বাড়ির সামনেটা সারি দিয়ে সুপারী গাছ ছিল। আর বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতর শিউলি, টগর,জবা আর কাঠটগর গাছ ছিল। ভোরের আবছা আলোয় সবাই ফুলচুরি করতে আসতো। আমরা কেউই পুজোর ফুল পেতাম না। আমি মায়ের কাপড় পরে ভোরবেলা ছাদের কার্নিশ বেয়ে নেমে গাছের মধ্যে বসে থাকতাম সবাইকে পেত্নীর ভয় দেখাবো বলে। শম্পা থামের আড়ালে লুকিয়ে থাকতো। আর দুজনে নাকি সুরে কথা বলতাম। ভয়ে সব ফুলচোররা পালিয়ে যেতো।
সে বছর মহালয়ার আগেরদিন ভোর সাড়ে-চারটের সময় সবে কাপড় পরে কার্নিশে নামতে যাবো হঠাৎ দেখি কালো কাপড়ে সারা শরীর মুড়ে গাছের ডাল ধরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব ভয় পেয়ে আমি ছাদ থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। এদিকে শম্পাও ভেবেছে আমিই বুঝি কালো কাপড় পড়েছি। বার দুয়েক আমার নাম ধরে ডেকে সাড়া না পেয়ে সেও ছুটে ঘরে পালিয়ে গিয়েছিল। আর কোনওদিন সাহস হয়নি পেত্নী সাজার।
এবার বলবো সেই ভয়ঙ্কর রাতের ঘটনা। সে রাতে যে ঘটনা ঘটেছিল তা আচ্ছা আচ্ছা বড় মানুষকেও হার্টফেল করিয়ে দিতে পারতো!
সে সময় ফোনের চল ছিল না। রোগ শোকের জরুরী খবরাখবর ব্যক্তি মাধ্যমে দেওয়া-নেওয়া চলতো। আর চাইলেই চারচাকা গাড়ি মিলতো না। ট্রেন বাসই ভরসা ছিল।
ডিসেম্বর মাসে সেবার ভীষন ঠাণ্ডা পড়েছিল।
আমার বৌদি তার দাদার বিয়ে উপলক্ষে একদিন আগেই বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। সঙ্গে গিয়েছিল বড়দা আর আমার ছোট দাদা। আমার মেজদি, আমি, আমার দিদির ছেলে ভোলা, আর বাবা মা বাড়িতে ছিলাম। বিয়ের দিন সকালে বাবা-মার সঙ্গে আমাদের সকলের যাবার কথা।
আমার মেজদির Asthama অর্থাৎ হাঁপানির টান হতো। এমনিতেই সারা শীতকাল বিছানা থেকেই সে উঠতে পারতো না, তার ওপর সেদিন সকাল থেকে ওর পেটের যন্ত্রণা শুরু হলো।
ঘরে থাকা কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। অসম্ভব যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দুপুর গড়ালো। আমার দাদা শ্বশুরবাড়ির বড়ো জামাই। বরযাত্রীদের সকলকে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দাদার উপর। বাবা পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে বাড়ির খবর পাঠিয়ে দিলেন সেখানে। আর বলে দিলেন, দাদার আসার দরকার নেই। নিচের ঘরের কাকুকে নিয়ে তিনি সামলে নেবেন।
শীতকালের বিকেল হতে হতে ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে যায়। মেজদির অমন ছটফটানি যন্ত্রনায় কাতরানো দেখে মা ভীষন উতলা হয়ে পড়লেন। বাবা আর অরবিন্দকাকু ডাক্তার ডেকে আনলেন। ডাক্তারবাবু ভালো করে দেখে বললেন ভালো বুঝছি না, এখনই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। একটা গাড়ি ডেকে খুঁজে আনতেও একঘন্টার উপর সময় লেগে গেলো। এদিকে কষ্ট আরও বাড়ছে। সে যন্ত্রণা চোখে দেখে সহ্য করা যাচ্ছিলো না। গাড়ি আসার পর বাবা অরবিন্দ কাকুকে বললেন শুধু ছোট মেয়ে আর নাতিটাকে রেখে সবাই যাওয়া যাবে না। আমাকে সই-সাবুদ করতে হবে তাই আমি যাই, আপনি বাড়িতে থাকুন। ততক্ষণে পাড়ার অনেকেই এসেছে। তাদের মধ্যে দুজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মা মেজদিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো মেজদির জন্যে। শীতকালের সন্ধ্যে তখন একপ্রহর রাত্রি হয়ে ধরা দিয়েছে।
মেজদি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দু’দিন আগেই শম্পার মা ছোট দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। টুম্পা-শম্পা আর কাকু বাড়িতে ছিলেন। মেজদির জন্যে মন খারাপ করে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম, সঙ্গে ভোলা আর টুম্পা-শম্পা ছিল। কাকু নিজের ঘরে গেলেন চা করতে।
কিছুক্ষণ পর শম্পার মামার বাড়ির পাড়ার একজন এসে খবর দিলো শম্পার দিদার অবস্থা খুব খারাপ। কলতলায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে, কপালে রক্ত জমে ক্লট হয়েছে। পড়ে যাবার পর থেকে আর চোখ খোলেনি কথাও বলেনি। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে,দিদি একা কি করবে বুঝতে পারছে না। এখনই আপনাদের যেতে হবে। শম্পার দুই মামা-ই বাইরে চাকরি করতেন। যাদবপুরের মামার বাড়িতে ওর দিদা একাই থাকতেন। শম্পার মা মাঝে মাঝে গিয়ে দেখাশুনা করে আসতো।
শুনে কাকুর মাথায় হাত পড়লো! টুম্পা-শম্পা বললো বাবা, তুমি আমাদের মামারবাড়ি কোনওরকমে পৌঁছে দিয়েই এখানে ফিরে আসবে। আমরা গিয়ে ভাইবোনেদের রাখবো, তাহলে মা দিদাকে দেখতে যেতে পারবে।
সে সময় আমাদের বয়সী মেয়েরা ছোট ভাইবোনদের দিব্যি সামলে রাখতে পারতাম। বারুইপুর থেকে যাদবপুর যেতে বেশি সময় লাগে না। কাকু আমাকে বললো চিন্তা করিস না। আমি যাবো আর আসবো। একটুও ভয় পাবি না। বাড়িতে ঠাকুর আছে, কোনও ভয় নেই।
আমাদের ওই বাড়ি থেকে ঢোকা বেরোনোর মাত্র একটাই গেট। দুটো চাবি দুই ভাড়াটের কাছে থাকতো। ফিরতে রাত হলে আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাই বাবা-মা একটা চাবি নিয়ে গিয়েছিলেন আর কাকু মেয়েদের নিয়ে যাবার সময় গেটে চাবি দিয়ে চলে গেল। কোনও দরকারেই আর আমরা বাইরে বেরোতে পারবো না।
সাতটা, আটটা, ন’টা বেজে গেল! ওই বাড়িতে আমরা দুটো ছোট ছেলে মেয়ে। কিছুই করার নেই। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ঘর-বারান্দা করছি। টিভি ছিল না। ফোন ছিল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে আশেপাশের কারুর বাড়ি চলে যাবো বা কাউকে ডেকে নেবো আমাদের সঙ্গে থাকার জন্যে তারও উপায় নেই। ব্যস্ততার মধ্যে কাকুর থেকে চাবিটাও নেওয়া হয়নি।
সন্ধ্যে থেকে কিচ্ছু খাওয়াও হয়নি। চোখের পাতা টেনে টেনে ধরে রেখেও ভোলাকে আর জাগিয়ে রাখতে পারিনি। দশটা বাজার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও পাশে শুয়ে রইলাম। বাবা-মাও আসছে না! কাকুও আসছে না! খানিক বাদে শুনলাম পাড়ার যে দুজন মেজদিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের একজন আমার নাম ধরে ডাকছে। বারান্দা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। সে বললো তোর মেজদিকে ভর্তি নিয়ে নিয়েছে, রাত বারোটায় অপারেশন হবে। কাকু কাকিমা ফিরতে পারবে না আজ রাতে।
কথাটা শুনেই ভয়েতে ডুকরে কেঁদে উঠলাম! আমি একা কি করে সারারাত থাকবো! কথাটা ভাবতেই, মনে হলো একশো জোড়া চোখ যেন আমাকে দেখছে। অনেক করে ডাকলাম ভোলা এই ভোলা, একবার ওঠ। ভোলার ঘুম ভাঙলোই না। কি করবো! কেবলই সন্দেহের চোখে দেখছি! এই বুঝি কেউ চলে গেলো বারান্দা দিয়ে। কান খাড়া করে শুনছি,কিছু খুটুর খাটুর শব্দ পেলেই খুঁজছি শব্দটাকে। ভোলার পাশে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছি কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই আবার চোখ খুলে ফেলছি ভয়েতে।
এমন করে কতক্ষণ কেটেছে জানি না। সন্ধ্যে থেকে বাথরুমেও যায়নি। ক্ষিধেতে এক মিনিটও দাঁড়াতে পারছিনা! বাবা বলতেন ভয় পেলে “জয় তারা” বললে ভয় কেটে যায়। সাহসে ভর করে মনে মনে বলতে লাগলাম জয় তারা, জয় তারা, জয় তারা…….
কোনওমতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, মুড়ি-বিস্কুট যা পাই নিয়ে ঘরে চলে আসবো। হঠাৎ সব আলোগুলো নিভে গেলো! হাতের কাছে টর্চও নেই। আচমকা দেখি দাদার ঘরের ভেতর থেকে খচ্ খচ্ ঠং ঠং শব্দ আসছে। আর ঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দ সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে বুকে যেন হাতুড়ির মতো ঘা মারছে। রাত তখন নিশুত নিঃস্তব্ধ। ছোটবেলার সেই ভয়ঙ্কর দিনের ঘটনাটা আজ আমাকে সেদিনের অনুভূতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো।
আমাদের বাড়ির আলোগুলোই শুধু নিভে গিয়েছে, রাস্তার পোস্টের হলুদ বাল্বের আলো ঘরে এসে পড়েছে বন্ধ কাঁচের জানলার ভেতর দিয়ে। সেই আবছা আলোয় দেখতে পেলাম কালো একটা ছায়া মূর্তি! মুখ থেকে হিজবটা সরানো! মুখটা খুব হিংস্র হয়ে উঠেছে। একটা চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে! আর তার হাতে একটা লম্বা ছোৱা!
তারপর সেই ছোরাটা নিয়ে কালো ছায়ামূর্তিটা হিংস্রভাবে বার বার আর একটা পুরুষ ছায়ামূর্তিকে কোপাতে লাগলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কোপানো দেহটা। রক্ত গড়িয়ে এসে যেন আমার পা-দুটোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে! কি ঠান্ডা রক্তটা! আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু শক্তিতে কুলোলো না সেখান থেকে পালিয়ে যাবার। হিজাব পরা নারীমূর্তিটা এরপর কোপানো দেহটাকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে বাগানের দিকে চলে গেলো! খানিক বাদে দেখি ঘড়ায় করে জল এনে সেখানে ঢেলে দিচ্ছে, আবার গেলো একঘড়া জল এনে ঢেলে দিলো। আবার গেলো আরেক ঘড়া! আবার যখন ঘড়ায় করে জল আনছে তাই দেখে আমি নিজের কানদুটোকে চেপে রেখে পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম।
আমার কান্না শুনে ভোলা ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন আমার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছিল না। অজান্তেই মুখের উপর হাতটা চেপে রেখেছি। ঘটনাটা আমি স্বজ্ঞানে স্বচক্ষে দেখেছি তাতে কোনও ভুল নেই। খেয়াল আছে ঘরের আলোগুলোও আবার জ্বলে উঠেছিলো। আর দেখেছিলাম কেউ যেন আমাকে ধরে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যাস! তারপর আর কি হয়েছিল আর কিচ্ছু জানি না।
শুনেছিলাম, সেদিন অরবিন্দকাকু শত চেষ্টা করেও লাস্ট ট্রেনটা ধরতে পারেননি। তাই একজনের মোটর সাইকেলে চেপে রাত সাড়ে-তিনটেয় বাড়ি এসেছেন। আমাদের দোতলায় ওঠার গেটটা ছিল হাফগেট। কাকু বাড়িতে ঢুকেই আমার কান্না শুনে দোতলার গেট ডিঙিয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে আমাদের ঘরে ঢুকেছিলেন।
সেইদিন রাতে আমার মেজদির অপারেশন হয়েছিল। ওর ইউটেরাসে বিশাল বড়ো সাইজের টিউমার ছিল। সে রাতে অপারেশন না হলে নাকি সেটা ফেটে (Burst) করে মারাত্মক কিছু হয়ে যেতো। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলেছেন ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে মেজদি নাকি অত বড়ো টিউমার বয়ে বেড়াচ্ছিল,কিন্তু সেটা সে বুঝতে পারেনি। পরেরদিন একটু বেলায় বাবা-মা ফিরেছিল। তখন আমি অচৈতন্য ছিলাম।
আমি রাতের ঘটনার কথা বাবা-মাকে বলেছিলাম। মায়ের নাকি ওখানে বসেই বাড়ির জন্যে মনটা ছটফট করছে। তবু অরবিন্দ কাকুরা আছে জেনে কিছুটা নিশ্চিত ছিল। বাড়িতে এসে সব শুনে তো অবাক হয়ে গিয়েছিল যে গত রাতে আমরা ছোট দুজন এই বাড়িটাতে একা ছিলাম! তবে বাবার কথা শুনে মনে হয়েছিল তেমনভাবে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু অরবিন্দকাকু এসে আমাকে ওই ভয় পাওয়া, বিধ্বস্ত, অজ্ঞান অবস্থায় দেখেছিলেন। তাই কিছুটা হলেও আমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন। কেননা উনি আমার বাবাকে বলেছিলেন জানেন দাদা, আমার বউ মেয়েরাও ভয় পাচ্ছে এই বাড়িতে থাকতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এই বাড়ি ছেড়ে দেবো।
শম্পারা একমাসের মধ্যেই যাদবপুরে মামারবাড়ির কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে গেলো।
ওই বাড়ি ছেড়ে আবার সবকিছু গুটিয়ে-পাটিয়ে অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া নিতে হবে তাই বাবা বিভিন্ন যুক্তি দিচ্ছিলেন যে, ওসব আমাদের মনের ভুল। ভুত প্রেত আত্মার গল্প শুনে শুনে মনের মধ্যে অমূলক ভয় জন্মেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শম্পারা চলে যাবার পর মায়ের চাপে শেষ পর্যন্ত আমরাও ওই কবরখানার ঘরবাড়ি ছেড়ে বারুইপুরেই অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। সময়ের সাথে সাথে ক্রমশঃ ফিকে হতে হতে ভুলেই গিয়েছিলাম সে সব কথা।
আজ দীর্ঘকাল পর শম্পার সঙ্গে আবার দেখা হতেই সেই ‘কবরখানার ঘর’-এর ঘটনাগুলো অতীত আ্যলবামের মতোই চোখের সামনে ভেসে উঠলো……
~ সমাপ্ত ~
শ্রাবণী চ্যাটার্জি
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ-ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়।
শখ- হস্তশিল্প নাচ, নাটক, আবৃত্তি, সেলাই, ফেব্রিক, উল বোনা,রান্না, আর ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে সুন্দর শো-পিস তৈরি করা। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং পাখী পরিচিতি নিয়ে লেখাও শুরু করেছেন।
“জীবন ও গল্প অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। যা দেখি, যা শুনি, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে, তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করি।”